ইসলামী মূলনীতির গতিধারা চোদ্দশ বছর আগের অন্ধকার যুগের বুক চিরে এ বিশ্ব ধরিত্রীতে শান্তির আলো নিয়ে এসেছিল যা অদ্যাবদি বহমান কাল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে প্রশংসনীয় হয়ে আছে, ইসলাম মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবন, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের সকল শাখায় মানুষের কল্যানের দিকে সুদৃষ্টি রেখেছে। বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি বর্জন করে মধ্যম পন্থায় মানব জীবনকে এনে দিয়েছে এক অত্মসংযমী জীবন ব্যবস্থা। কথাবার্তা চলাফেরা ও লেনদেন সহকারে রয়েছে নানাবিধ নীতিমালা, যার অন্যতম একটি বিষয় হলো বিবাহ ও (অনন্যপায় হলে) তালাক।
ইসলামী আইনে তালাকের বিধানাবলী

সূচিপত্র

ইসলামী আইনে তালাকের বিধানাবলী

বিবাহ ও তালাকের শরীয়তসম্মত মর্যাদা।

মুফতী ইউনুস আলী (কাঁচপুর)
ইসলামী মূলনীতির গতিধারা চোদ্দশ বছর আগের অন্ধকার যুগের বুক চিরে এ বিশ্ব ধরিত্রীতে শান্তির আলো নিয়ে এসেছিল যা অদ্যাবদি বহমান কাল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে প্রশংসনীয় হয়ে আছে, ইসলাম মানুষের রাষ্ট্রীয় জীবন, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের সকল শাখায় মানুষের কল্যানের দিকে সুদৃষ্টি রেখেছে। বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি বর্জন করে মধ্যম পন্থায় মানব জীবনকে এনে দিয়েছে এক অত্মসংযমী জীবন ব্যবস্থা। কথাবার্তা চলাফেরা ও লেনদেন সহকারে রয়েছে নানাবিধ নীতিমালা, যার অন্যতম একটি বিষয় হলো বিবাহ ও (অনন্যপায় হলে) তালাক।

মহান আল্লাহ তা‘আলা ধরাকে সাজালেন ও পূর্ণতার রুপদিলেন মানগোষ্ঠী দ্বারা যার অন্যতম হলো পুরুষ আর তার জীবনসঙ্গিনী বানালেন স্ত্রীকে, যাদের মধ্যকার এক সম্পর্ক হলো বিবাহ বন্ধন। কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন নস দ্বারা বারবার-ই এ সম্পর্ক মধুময় ও কমল রাখর প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। জীবন যেন সুখময় হয় তার দিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অনেক জোর দিয়ে। তদুপরি কিছু কিছু সময় নানাবিধ কারনে এ সম্পর্কে নেমে আসে চরম বিপর্যয় !
আর জীবনে এ চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে স্বামী স্ত্রী উভয়কে রক্ষার জন্য ইসলামে তালাকের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়ছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দখো দেয়, পরস্পর মিলেমিশে স্বামী স্ত্রী হিসেবে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্যমন্ডিত জীবন যাপন যখন একবারই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, পারস্পরিক সর্ম্পক যখন হয়ে পড়ে তিক্ত, বিষক্ত, একজনের মন যখন অপরজন থেকে এমন ভাবে বমিূখ হয়ে যায় যে, তাদরে শুভ মলিনরে আর কোনো সম্ভাবনা থাকেনা; ঠিক তখনই এই চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামে। তালাক হচ্ছে নিরুপায়ের উপায়।
সাথেসাথে এ কথাও বলা হয়েছে যে তালাক আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুবই ঘৃণ্য অপছন্দনীয় কাজ, যথাসম্ভব এ থেকে বেঁচে থাকবে।

কেননা রাসূল সাঃ বলেন;
হালাল বিষয়ের মধ্যে সর্বাধিক ঘৃণ্য বিষয় হচ্ছে তালাক।

অন্যত্রে এসেছে
তোমরা বিবাহ করো কিন্তু তালাক দিও না কেননা তালাকের কারণে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে।

তালাকের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ

  • তালাক শব্দটি বাবে نَصَرَ- يَنْصُرُ থেকে এসেছে, যার শাব্দিক অর্থ হলো বন্ধন মুক্ত করা বা বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা ।
  • অন্যত্র আছে তালাক অর্থ- উত্থান করা, পরিত্যাগ করা, বন্ধন মুক্ত হওয়া, প্রত্যাখ্যান করা, বিবাহ বিচ্ছেদ করা ইত্যাদি।

পরিভাষায়  তালাক বলা  হয়ঃ-

  • বিশেষ কিছু শব্দ দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা।
  • বিবাহের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার অর্জিত সম্পর্ক শরিয়ত নির্ধারিত কিছু শব্দ প্রয়গ করার মাধ্যমে ছিন্ন করাকে তালাক বলা হয়।
  • বিবাহ বন্ধন তুলে নেওয়া এবং খুলে দেওয়া এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার  সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া

তালাকের ধর্মীয় হুকুম

  • কখনো কখনো তালাক দেওয়া জুলুম,
  • কখনো মুস্তহাব,
  • কখনো ওয়াজিব,
  • আর কখনো  হারাম।

আমরা নিম্নে এ সকল বিষয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্।

তালাকে জুলুম

যখন স্ত্রী কোনো অন্যায় না করবে বরং সে সতীসাধ্বী থাকবে এমতাবস্থায় স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়া জুলুম ও অন্যায় হবে।
আল্লাহ তালার বানী-

فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا

অর্থ : যদি তারা তোমাদের অনুসরণ করে তাহলে তোমরা তাদের উপর কোনো অন্যায় রাস্তা অবলম্বন করো না।
(সূরা নীসা ৪/ ৩৪) 

মুস্তহাব তালাক

  • স্ত্রী যদি ফরজ নামাজ আদায় না করে, অথবা যে নামাযই পড়ে না ।
  • স্ত্রী যদি ধর্মীয় যে কোনো ফরজ বিধান আমলে না আনায় অভ্যস্ত হয় তখন তালাক দেওয়া মুস্তহাব। 
    (ফতুওয়ায়ে শামী ৪ নং খন্ড ৪১৬ পৃঃ)
  • স্ত্রী যদি স্বামীর জন্য যে কোনো বিষয়ে প্রতিনিয়ত কষ্ট প্রদানকারীণী হয়।
    (ফতুওয়ায়ে শামী ৪ নং খন্ড ৪১৬ পৃঃ)

তালাক দেওয়া ওয়জিব

স্বামী যখন স্ত্রীর হক পুরন করার ক্ষেত্রে অপারগ হয় তখন স্বামীর জন্য স্ত্রীকে তালাক দেওয়া ওয়াজিব।
(ফতুওয়ায়ে শামী ৪ নং খন্ড ৪১৭ পৃঃ)

তালাক দেওয়া হারাম

তালাক তিন প্রকার, যার তৃতীয় প্রকার হলো তালাকে বেদআত, তালাকে বেদআতের তিনটি প্রকার রয়েছে, যার যেকোনো এক প্রকার তালাক দেওয়া  হারাম। এ তিন প্রকারের আলোচনা সামনে আসছে।
(ফতুওয়ায়ে শামী ৪ নং খন্ড ৪১৭ পৃঃ)

তালাকের প্রকারভেদ ও তার হুকুম 

সমস্ত ফিকহী কিতাব এ বিষয়ে একমত যে, মূলগত দিক থেকে তালাক তিন প্রকার। যেমনটি ফতোয়ায়ে শামীতে রয়েছে যে,   اٌقسامه  ثلاثة   অর্থাৎ তালাক তিন প্রকার   
(১)  احسن বা অতি উওম 
(২)  حسن বা উওম 
(৩)  بدعة বা বেদ‘আত  

(১) احسن বা অতি উওম তালাক বলা হয় ।

স্ত্রী তার মাসিক (ঋতু) থেকে পবিত্র হওয়ার পর স্বামী ঐ পবিত্রতা অবস্থায় তার সাথে কোনো ধরনের সহবাস না করে ঐ পবিত্রতায় স্ত্রীকে এক তালাক দিবে ; এরপর থেকে পরবর্তি তিন হায়েজ (ঋতু) পর্যন্ত  অপেক্ষা করবে এবং এর মধ্যে স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে না । এইভাবে তিন হায়েজ শেষ হলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে।
এই ধরনের তালাকের হুকুম হলো;
সময় শেষ হলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে এবং নতুন বিবাহ ছাড়া তারা দুজনে আর এক সাথে হতে পারবে না ।

(২) حسن বা উওম তালাক  বলা হয়;

ঋতু থেকে পবিত্র হলে তার পরবর্তি প্রথম পবিত্রতায়- এক তালাক, দ্বিতীয় পবিত্রতায়-দ্বিতীয় তালাক এবং তৃতীয় পবিত্রতায়- তৃতীয় তালাক প্রদান করা। যার মধ্যে কোনো সহবাস করবে না।
এই ধরনের তালাকের হুকুম হলো;
এই তিন তালাকের তৃতীয় তালাকের পবিত্রতা শেষ হলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে এবং হিলা/হিল্লা ছাড়া তারা দুজনে আর একসাথে হতে পারবে না।

(৩) بدعة বা বেদআত তালাক বলা হয়ঃ-

নিম্নে বর্ণিত তিন সূরতের যে কোনো এক ভাবে তালাক দিলে তাকে বেদআত তালাক বলা হবে

  • একবারে তিন তালাক দেওয়া।
  • হায়েজ তথা মাসিক অবস্থায় তালাক দেওয়া। 
  • যে পবিত্রতায় সহবাস হয়েছে তার মধ্যে তালাক দেওয়া। 

এই ধরনের তালাকের হুকুম হলো ;
এমন তালাক দিলে তালাক হয়ে যায়। অবশ্য এমনটা করা হারাম ও গুনাহের কাজ। আর তাছাড়া এক সাথে তিন তালাক দিলে তার দ্বারা তালাকে মুগাল্লাযা হয়ে যায়, বিধায় হিলা/হিল্লা ছাড়া ঐ স্ত্রী তার জন্য হারাম।

الفاظ الطلاق বা তালাক প্রদানের শব্দসমূহ 

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি তালাক অর্থ কী, তালাক দেওয়ার নিয়ম কী, তো এখন আমরা জানবো তালাক দেওয়ার শব্দগুলি কী কী? কোন কোন শব্দ দ্বারা তালাক হয়, আর কোন শব্দ দ্বারা তালাক হয় না।

তালাকের শব্দগুলো ২ ভাগে বিভক্ত;

(১) صريح বা তালাকের সুস্পষ্ট শব্দ।
(২) كناية বা তালাক দেওয়া ও হওয়ার ক্ষেত্রে অস্পষ্ট শব্দসমূহ।

তালাকের সুস্পষ্ট শব্দগুলো হলো ;

  • তুমি তালাক বা আমি তোমায় তালাক দিয়ে দিলাম। স্বামীর এ কথার মধ্যে দেখতে হবে সে কী নিয়ত করেছে? এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক, না সোজা বাইন তালাক। এর মধ্যে সে বলার সময় যে তালাকের নিয়ত করবে তাই হবে, আর যদি সে কোনো নিয়তই না করে তাহলেও এক তালাকে রজয়ী হবে।
  • আমার উপর তুমি হারাম, আমার জন্য ওয়াজিব হলো তোমায় তালাক দেওয়া। এমনটা বলার দ্বারা তালাকে বায়েন হয়ে যাবে।
  • তোমার শরীর/দেহ, তোমার রুহ, তোমার চেহারা বা তোমার লজ্জাস্থান তালাক বা আমার উপর হারাম তাতেও তালাক হয়ে যাবে।
    (শামী ৪/৯৫)
  • যাও তোমাকে রাখবো না তালাক, তালাক, তালাক, বায়েন তালাক বা তিন তালাক এমন শব্দগুলো বলার দ্বারা তিন তালাকে বায়েন হয়ে যাবে।

তালাক দেওয়া ও হওয়ার ক্ষেত্রে অস্পষ্ট শব্দসমূহ;

যদি কেউ রাগের মাথায় অথবা তালাকের আলোচনা চলাকালীন সময় নিচের শব্দগুলো উল্লেখ করে এবং তার তালাকের নিয়ত থাকে তাহলে তালাক হয়ে যাবে। যেমনঃ

  • ১.যা, আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা।
  • ২.আজ থেকে আমার বাড়ি খালি করে দিবি।
  • ৩.যা, তুই এখান থেকে চলে যা।
  • ৪.আজ থেকে তুই আমার থেকে পর্দা করবি।
  • ৫.যা,আজ থেকে তুই একা আর আমিও একা। আজ থেকে তুই আজাদ/মুক্ত ।
  • ৬.আজ থেকে তোর দাইত্ব তোর, আমারটা আমার। আজ থেকে আমার সমস্ত দায়িত্ব থেকে তোকে মুক্ত করে দিলাম।
  • ৭.যা,আজ থেকে তুই তোর তালাকের মাসিক (ঋতু )গনা শুরু কর।
  • ৮.যা ,আজ থেকে বাপের বাড়ি থাকবি।
  • ৯.যা ,অন্য কোনো স্বামী দেখ।

(এর মধ্যে এমন কিছু শব্দ আছে যার দ্বারা এক তালাকে রজয়ী হয়, আবার কখনো বায়েন তালাক হয়, যাই হোক এমন কোনো শব্দ মুখে চলে আসলে আমরা আলেমদের নিকট মাস‘আল জেনে নিবো।)
(শামী ৪/৫১৭)

বিঃদ্রঃ
তালাকের অস্পষ্ট শব্দগুলো দ্বারা সাধারণত তালাকে রজয়ী হয়, যার কারণে কোনো ধরণের বিয়ে ও হিলা/হিল্লা ছাড়াই নিজের বিবি-কে নিজের কাছে রাখা যায় কেননা উপরুক্ত শব্দ থেকে যে কোনো একটা শব্দ বললে সাথে সাথে বিবাহ ছিন্ন হয় না। অবশ্য এ শব্দ বলার পর কিছু করণীয় আছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো।

তালাকে রজয়ী বলতে কী বুঝায়?

রজয়ী একটা আরবী শব্দ যা বাবে ضَرَبَ- يَضْرِبُ থেকে এসেছে, যার শাব্দিক অর্থ হলো; ফিরিয়ে নেওয়া, প্রত্যাবর্তন করা, কিছু কিছু সময় তালাকের শব্দ বলার পরও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া যায় আর যে তালাকের পরও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া যায়, তাকে তালাকে রজয়ী বলে। যেমন;

  • তালাকের প্রথম সূরতে এক তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীর তিন হয়েজ (মাসিক) শেষ হওয়ার আগেই এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে নেওয়া।
  • আবার তালাকের দ্বিতীয় সূরতের মধ্যে প্রথম তালকের পর যে তুহুর (পবিত্রতা) আসে বা দ্বিতীয় তালাকের পর যে তুহুর (পবিত্রতা) আসে এবং তৃতীয় তালাক দেওয়ার পর যে তৃতীয় তুহুর (পবিত্রতা)  আসে তা শেষ হওয়ার আগে।

এ দির্ঘ সময়ের মধ্যে স্বামী যদি তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় তাহলে এ তালাক-কে তালাকে রজয়ী বলা হবে।
এখন কথা হলো ফিরিয়ে নিবে কিভাবে ?
অবশ্য এ ফিরিয়ে নেওয়ার কিছু নীতিমাল রয়েছে, যেমন স্বামী স্ত্রীকে বললো; আমি তোমায় রাখতে চাচ্ছি- আগে যা বলেছি তা ফিরিয়ে নিলাম অথবা স্বামী স্ত্রীকে সেচ্ছায় স্পর্শ করল তাকে রাখার উদ্দেশ্যে বা তাকে চুম্বন করল বা তার সাথে মেলামেশা (সহবাস) করল, ইত্যাদি।

তাফয়ীজে তালাক/ডিভোর্স এর বিধান

তফওয়ীজ একটা আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হলো; অর্পণ করা, সমর্পণকরা, দাইত্ব প্রদান করা, ইত্যাদি। আর তালাক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তালাক। অতএব তায়ওয়ীজে তালাকের অর্থ হলো; তালাকের দাইত্ব অর্পণ করা। আসলে তালাক সর্বদাই বিবাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিধায় বিবাহের মাধ্যমে তালাকের আধিকার অর্জন হয়। এ অধিকার নারীর নয় বরং পুরুষের। ইসলামে এমন অনেক বিধান আছে- যা শুধু মাত্র পুরুষের সাথে সীমাবদ্ধ, নারীদের সাথে নয়। তার অন্যতম একটা হলো তালাক।
কেননা মেশকাত শরীফের এক হাদীসের মধ্যে আছে মহিলারা ধর্মীয় অনেক বিষয়ে পুরুষের অর্ধেক কেননা জ্ঞাণকোষগত দিক থেকে মহিলাদের চেয়ে পুরুষের জ্ঞাণকোষ তুলনামূলক ভাবে অনেকটা বেশী শক্তিশালী হয় আর তালাক মানুষের পার্থিব জীবনের অন্যতম একটা অংশ বিধায়, তা যে কোনো হস্তে রাখা যায় না। এ কারণে তালাকের আধিকার আল্লাহ্ তা‘আলা শুধুমাত্র পুরুষের জন্য রেখেছেন।  অবশ্য পুরুষ যদি চায় তাহলে নারীকে এ আধিকার দিতে পারে যে, সে তার স্বামীর থেকে তালাক নিবে আর পুরুষ যদি না চায় যে, আমি এ অধিকার আমার স্ত্রীকে দিব না তাহলে স্ত্রী স্বামীর থেকে তালাক নিতে পারবে না।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো পুরুষ এ অধিকার দিলে দিতে পারে। তবে এ অধিকার দিতে হবে বিবাহ হওয়ার পর; আগে নয়। অধিকিন্তু এ আধিকার না দেওয়াই ভালো। কেননা ২০০৮ সালের এক পরিসংখনে দেখা গেছে যে, পুরুষের তুলনায় মহিলারা তার স্বামীকে তালাক/ডিভোর্স দিয়েছে পরিমাণে অনেক বেশি।
অতএব বোঝা গেল; স্বামী কর্তৃক তার স্ত্রীর তালাক গ্রহনের ক্ষমতা প্রদান করাকেই তাফওয়ীযে তালাক বলা হয় ।

এক তালাকে বায়েন ও তিন তালাকে বায়েনের বিধানঃ

তালাকের তিন সূরতের মধ্যে প্রথম প্রকার তালাক সব থেকে উত্তম অতঃপর দ্বিতীয় প্রকার তালাক আর তৃতীয় প্রকার তালাক তো উত্তম নয়ই বরং এমন তালাক দেওয়া হারাম ও তার দ্বারা চরম গুনাহ হয়। বিধায় কেউ যদি স্ত্রীকে উত্তম তালাক (প্রথম প্রকার তালাক) হিসাবে এক তালাক দিয়ে তিন মাসিক (ঋতু) পর্যন্ত তাকে অবকাশ দিয়ে রাখে, তবে তৃতীয় মাসিক (ঋতু) শেষ হলে স্ত্রীর উপর তালাকে বায়েন হয়ে যাবে। যাকে এক তালকে বায়েন বলা হয়।

উপরোক্ত ধরণের তালাকের হুকুম হলো;

এই ভাবে তালাক দিলে তিন মাসিক (ঋতু) শেষ হলে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে এবং স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। অবশ্য এই স্বামী যদি ঐ স্ত্রীকে নিজের কাছে রাখতে চায় তাহলে স্বামীর জন্য আবশ্যক হলো; ঐ মহিলাকে আবারো বিবাহ করা।

ঠিক এভাবে যদি তালাকের দ্বিতীয় সূরতে প্রথম মাসে এক তালাক, দ্বিতীয় মাসে দ্বিতীয় তালাক এবং তৃতীয় মাসে তৃতীয় তালাক দেয় তবে তৃতীয় মাসিক (ঋতু) থেকে পাক (পবিত্র) হওয়ার পর স্ত্রীর উপর তালাকে বায়েন পতিত হয়ে যাবে। যাকে তিন তালাকে বায়েন বলা হবে।
কিন্তু যদি তালাকটা তালাকে বেদআত হয় (তৃতীয় প্রকার) অর্থাৎ এক সাথে তিন তালাক দিয়ে থাকে তাহলে এই তিন তালাক-কে “তালাকে বায়েনে মুগাল্লাযা” বলা হবে।

উপরোক্ত উভয় ধরণের তালাকের হুকম হলো;

এ রকম তালাকের ক্ষেত্রে স্বামী যদি পুনরায় ঐ স্ত্রীকে বিবাহ করে, তাতেও ঐ স্ত্রী তার জন্য বৈধ হবে না, বরং ঐ স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হতে হবে এবং অন্য স্বামীর সাথে স্ত্রীর শারীরিক মিলন হওয়ার পর স্বামী যদি তাকে সেচ্ছায় তালাক দেয়, তাহলে পুনরায় নতুন বিবাহের মাধ্যমে প্রথম স্বামীর কাছে আসতে পারবে; নতুবা নয়। এ ক্ষেত্রে অনেকে হিলা/হিল্লা করে, যার আলোচনা সামনে আসছে-

বিঃ দ্রঃ
অনেক সময় স্বামী তার স্ত্রীকে তালাকের অনুমোদন না করলেও বা স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক না দিলেও স্ত্রী কোর্টে গিয়ে নিজ স্বামীকে তালাক/ডির্ভোস দিয়ে দেয়। যদি স্বামী তাকে অনুমোদন না করে থাকে তাহলে স্ত্রীর ডির্ভোস হবে না এবং সে অন্যত্রে বিবাহ করতে পারবে না। আর যদি স্বামী অনুমোদন করে থাকে তাহলে ডির্ভোস দিলে তালাক হয়ে যাবে, যার কারণে তাকে পরবর্তি তিন মাসিক (ঋতু) পর্যন্ত তালাকের ইদ্দত পালন করতে হবে, এর আগে বিবাহ করা হারাম ও গুনাহের কাজ।

হিলা/হিল্লা কাকে বলে ? ইসলামে হিলার হুকুম কি?

হিলা (حيلة) একটা আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হলো; কৌশল অবলম্বন করা, কোনো উপায় গ্রহণ করা, জটিল কোনো স্থানে ছল-চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করা।

পরিভাষায় হিলা বলা হয়; যখন শরিয়তের কোনো বিষয়ে মানব জীবনে জটিলতা দেখা দেয় তখন শরিয়ত সম্মত এমন কোনো উপায় অবলম্বন করা, যার দ্বারা শরিয়তের বিধান ঠিক থাকার সাথে সাথে মানুষ ঐ জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে পারে, আরবি ভাষায় এটাকে “হিলা/হিল্লা” বলে।

তালাকের ক্ষেত্রে হিলা/হিল্লা বলা হয়ঃ-
যখন কোনো স্বামী ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় অথবা রাগান্নিত হয়ে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, অতঃপর পরবর্তী সাভাবিক অবস্থায় সে তার পূর্বের স্ত্রীকে নিজ অধিনে স্ত্রী হিসাবে রাখতে চায়, অথচ ইসলামী আইনের কারনে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না বিধায় তার তালাক প্রপ্তা স্ত্রীকে তার নিকট ফিরিয়ে নেওয়ার যে মাধ্যম, তাকে ইসলামের দৃষ্টিতে হিলা/হিল্লা বলা হয়।
আর সে মাধ্যমটি হলো; প্রথম স্বামী তালাক দেওয়ার পর ঐ মহিলা অন্যত্র বিবাহ করবে এবং তার সাথে সংসার করবে। এর মধ্যকার চলমান সময়ে বর্তমান দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার শারীরিক মেলামেশা করতে হবে অতঃপর এ স্বামী যখন তার এ স্ত্রীকে তালাক দিবে তখন এই মহিলা তার প্রথম স্বামীর নিকট পূনরায় নতুন বিবাহের মাধ্যমে আসতে পারবে।
আর এটাই হলো বৈধ “হিলা/হিল্লা”, যা শরিয়ত সমর্থন করে। যেমন আল্লাহর বানী

“ فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ”

অর্থাৎ যদি সে (প্রথম স্বামী) তালাক দিয়ে দেয় তাহলে তার জন্য এ স্ত্রী আর জায়েয নয় যতক্ষন না সে স্ত্রী অন্য কোনো স্বামীর সাথে বিবাহ করে।
**অবশ্য এ বিষয়ে ইমরআতে রেফার হাদীসটি ও উল্লেখযোগ্য।**
কিন্তু বর্তমান সময়ে হিলা বলতে মানুষের একটা ভুল ধারনা রয়েছে, তা হলো; হিলা/হিল্লা বলা হয়; কোন স্বামীর তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে এ র্শতে বিবাহ করা যে, বিয়ের  পর সহবাস শেষে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিবে যাতে সে পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হয় এবং সে তাকে পুনরায় বিবাহ করতে পারে। এ বিবাহ বাতিল ও অশুদ্ধ, এর ফলে নারী তিন তালাক প্রদানকারী স্বামীর জন্য হালাল হয় না। বরং এমন গর্হিত কাজ করার কারণে হিলার সাথে যুক্ত সকলের উপর আল্লাহর লা‘নত পতিত হয়। 
যেমন আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ সাঃ বলেন;

وعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ : ” لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُحِلَّ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ ” [ أخرجه أحمد ، وابن ماجة ،

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাঃ বলেন; আল্লাহর নবী হিলাকারী ও যার জন্য হিলা করা হয় উভয়ের জন্য লা‘নত করেছেন।
(ইবনে মাজাহ ও আহমদ)

তালাকের ইদ্দতের মাসআলাঃ

  • ইদ্দত কাকে বলে?
  • ইদ্দতের শরয়ী হুকুম কী?
  • তালাকপ্রাপ্তা কোন মহিলার ইদ্দত কত দিন?
  • ইদ্দত কোথায় ও কিভাবে পালন করবে?
  • ইদ্দতে থাকাবস্থায় খরচ খরচা স্বামীর দিতে হবে কি? 

ইদ্দত কাকে বলে?

প্রতিটি তালাকপ্রাপ্তা মহিলা তালাকের পরবর্তী নির্ধারিত সময় পর্যন্ত প্রতীক্ষা করাকে ইদ্দত বলা হয়। সাধারণত মানুষের ধারনা যে, কোনো স্ত্রীর স্বামী মারা গেলে তার জন্য স্ত্রীর কিছুদিন ইদ্দত বা শোক পালন করতে হয়। আর এটাই হলো ইদ্দত, বাস্তবতা হলো; ইদ্দত শুধু স্বামী মারা গেলেই নয়! বরং যে কোনো অবস্থায় স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ হলে প্রতিটি স্ত্রীর জন্য এক নিদির্ষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতীক্ষা করা ফরজ। যার সময়সীমা শারিয়হ্ কর্তৃক নির্ধারিত।

ইদ্দতের শরয়ী হুকুম কী?

কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিক বা কোনো স্ত্রী (তাফয়ীজে তালাকের মাধ্যমে) তার স্বামী থেকে তালাক গ্রহণ করুক উভয় অবস্থায় স্বামী ও স্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা ফরজ। এ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে না, আর স্বামী যদি তালাক প্রদানের পর চতুর্থ স্ত্রী গ্রহন করতে চায়; তাও সে করতে পারবে না, যতক্ষণ এ চতুর্থ স্ত্রীর ইদ্দত শেষ না হয়। (যদি স্ত্রী চারজন থাকে তখনই শুধুমাত্র পুরুষের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে)
অনেক সময় দেখা যায় যে, স্ত্রীকে স্বামী তালাক দিলে বা স্ত্রী স্বামী থেকে  ডিভোর্স নিয়ে সাথে সাথে বা অল্প কয়েক দিনের মধ্যে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে এমন কাজ করা হারাম ও বড় গুনাহের কাজ। বিধায় নারী হোক কিংবা পুরুষ সকলের জন্য তালাক পরবর্তী ইদ্দত সর্ম্পকে জানা থাকা আবশ্যক এবং সে অনুযায়ী আমল করাও ফরজ।

বিভিন্ন শ্রেণীর তালাকপ্রাপ্তা  মহিলার ইদ্দতঃ

  • (১) প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা ঋতু (মাসিক) থেকে পবিত্র হওয়ার পর তালাকপ্রাপ্তা হলে তার জন্য ইদ্দতের সময়কাল হলো; সে যে পবিত্রতায় আছে তা থেকে পূর্ণ তিন মাসিক (ঋতু) শেষ হওয়া পর্যন্ত। অতএব তার তিন ঋতু শেষ হলে সে যথেচ্ছা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে তবে এর আগে অন্যত্র বিবাহ করা হারাম।

وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ

অর্থাৎ তালাকপ্রাপ্তা মহিলাগণ তাদের নিজেদের জন্য তিন মাসিক (ঋতু) পর্যন্ত অপেক্ষায় রাখবে।
(বাকারা: ২/২২৮)

  • (২) স্ত্রী যদি ছোট হয় যার মাসিক (ঋতু) হয় না,
    অর্থাৎ নাবালেগা হয়. এমন ছোট মেয়ে তালাকপ্রাপ্তা হলে তার ইদ্দত হলো; তিন মাস। এ সময়ের মধ্যে সে অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে না।

وَاللَّائِي يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيضِ مِنْ نِسَائِكُمْ إِنِ ارْتَبْتُمْ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَاثَةُ أَشْهُرٍ وَاللَّائِي لَمْ يَحِضْنَ

(সূরা তালাক: ৬৫/ ৪)

  • (৩) স্ত্রীর বয়স যদি এতো বেশি হয় যে তার মাসিক (ঋতু) হয় না। অর্থাৎ বৃদ্ধা মহিলা তবে তার ইদ্দত হলো; তিন মাস। এ সময়ে সে অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে না।

وَاللَّائِي يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيضِ مِنْ نِسَائِكُمْ إِنِ ارْتَبْتُمْ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَاثَةُ أَشْهُرٍ

(সূরা তালাক: ৬৫/ ৪)

  • (৪) স্ত্রী যদি গর্ভবতী হয় আর এমতাবস্থায় যদি সে তালাকপ্রাপ্তা হয় তাহলে তার ইদ্দত হলো; তার গর্ভের বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত।

وَأُولَاتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَنْ يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ

(সূরা তালাক: ৬৫/ ৪)

বিঃদ্রঃ
গর্ভবতী স্ত্রীকে তালাক দিলে স্বামীর জন্য অপরিহার্য হলো; বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত স্ত্রীর যবতীয় খরচ স্বামীর বহন করা, যাতে বাচ্চার কোনো ক্ষতি না হয় আর বাচ্চা প্রসব করার সাথে সাথে স্ত্রী তালাক হয়ে যায় এবং তার ভরণপোষণের দাইত্ব আর স্বামীর উপর থাকে না বিধায় ঐ বাচ্চাকে দুধ পান করানো স্ত্রীর জন্য আবশ্যক নয় অতএব স্বামী ঐ মহিলাকে দুধ পান করাতে বললে স্বামীর জন্য ঐ মহিলার দুধ পান করানোর পূর্ণ সময়ের ভরণ-পোষণ ও তার থাকা খাওয়া সহ সকল ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

وَإِنْ كُنَّ أُولَاتِ حَمْلٍ فَأَنْفِقُوا عَلَيْهِنَّ حَتَّى يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ فَإِنْ أَرْضَعْنَ لَكُمْ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ

(সূরা তালাক: ৬৫/ ৬)

  • (৫) স্বামী যদি তার স্ত্রী রেখে মারা যায় তাহলে তার ইদ্দত হলো; ৪ মাস ১০ দিন। এ সময়ের মধ্যে সে অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে না

وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنْكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا

(সূরা বাকারা: ২/২৩৪)

  • (৬) কোনো স্ত্রীর স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। অর্থাৎ বহুদিন হলো স্বামীর কোনো খোজ খবর নেই, বেঁচে আছে না মারা গেছে ? তাও জানা যায় না। এমন মহিলা তার স্বামীর জন্য ৪ বছর অপেক্ষা করবে, এর মধ্যে যদি স্বামী মারা গেছে এমন কোনো সংবাদ না পাওয়া যায় তা হলে  ৪ বছর পর চাইলে সে অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে।

ইদ্দত কোথায় ও কিভাবে পালোন করবে?

তালাক প্রপ্তা মহিলা তার স্বামীর কাছ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর স্বামীর ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও যাতে পারবে না। বরং স্বামীর ঘরেই থাকবে এবং স্বামীও তাকে ঘর থেকে বের করে দিবে না, এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন;

لَا تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخْرُجْنَ

“তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিস্কার করো না আর তারাও (স্ত্রীরাও) যেন গৃহ থেকে বের না হয়”
(সূরা তালাক: ৬৫/১)

বরং স্ত্রী সেখানেই খাবার খাবে, নামায সহকারে অন্যান্য যাবতীয় ইবাদত করবে আর যদি স্ত্রী বের হয়ে যায় বা স্বামী তাকে বের করে দেয় তাহলে তা হারাম ও মস্ত বড় গুনাহের কাজ হবে। স্বামীর ঘরে ইদ্দত পালনরত অবস্থায় যদি সে কোনো অশালীন কাজ করে তা হলে স্বামী তাকে গৃহ থেকে বের করে দিতে পারবে এর দ্বারা গুনাহ হবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বানী;

إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ

অর্থ “তবে যদি তারা কেনো প্রকাশ্য অশালীন কাজে জড়িত হয়” 
(সূরা তালাক:৬৫/১)

অশালীন কাজ বলতে বুঝানো হয়েছে যে,

  • পর পুরুষের সাথে কথা বলবে না।
  • পর পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করবে না।
  • প্রয়োজনীয় রুপচর্চার বেশি সাজবে না।
  • ইদ্দত চলাকালীন সময়ে পর পুরুষের সাথে নিজের বিবাহের আলোচনা করতে পারবে না এবং প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যভাবে ব্যভিচার করতে পারবে না।
  • স্বামীর সাথে ঝগড়া বিবাদ করবে না।
  • জোরে আওয়াজ করবে না, ইত্যাদি।

ইদ্দতে থাকাবস্থায় খরচ খরচা স্বামীর দিতে হবে কী?

স্বামীর জন্য ওয়াজিব হলো; তার অধীনে থাকা স্বীয় তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর থাকা-খাওয়া, পোশাক, যাবতীয় ভরণ-পোষণ ইত্যাদি বহন করা। এমনকি স্ত্রী অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বানী;

لِيُنْفِقْ ذُو سَعَةٍ مِنْ سَعَتِهِ وَمَنْ قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنْفِقْ مِمَّا آتَاهُ اللَّهُ

অর্থ: সচ্ছল ব্যক্তিদের উচিত তাদের সচ্ছলতা থেকে ব্যায় করা, আর যাদের আয় কম তাদের উচিত আল্লাহ প্রদত্ব সম্পদ থেকে যথাসাদ্ধ ব্যায় করা।
(সূরা তালাক ৬৫/৭)

অবশ্য সাজসজ্জার জন্য ও চাহিদার অতিরিক্ত টাকা দাবী করতে পারবে না। কিন্তু আফসসের বিষয় হলো; বর্তমান সময়ের তালাকপ্রাপ্তা মহিলাগণ তার স্বামীর বাড়িতে থাকেই না বললে ভুল হবে না! বরং বাবার বাড়িতে গিয়ে স্বামীর নামে মামলায় জড়িত হয়।

তালাক হয়ে যায় অথচ তালাক হয় না মনেকরা কিছু স্থানঃ

  • রাগান্বিত অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয়ে যায়, যদিও বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী রাগান্বিত হয়ে তালাক দিলে তালাক হয় না, মুখে মুখে তালাক দিলে তালাক হয় না। তবে ইসলামী আইন অনুপাতে তালাক হয়ে যাবে।
  • কাউকে যদি তালাক বা ডিভোর্স দিতে বাধ্য করা হয় আর সে বাধ্য হয়ে তালাক দেয় তাহলেও তালাক হয়ে যাবে।

ويقع طلاق كل زوج بالغ  عاقل ولو عبدا أو مكرهافإن طلاقه أي طلاق المكره صحيح 

(ফতুওয়ায়ে শামী ৪/৪২৭)

  • মাতাল অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয়ে যাবে। যেমন বর্তমান সময়ে অনেক পুরুষ বাহির থেকে নেশা করে ঘরে ফিরে, অতঃপর স্ত্রী কিছু বললে মারধর করে ও মুখে মুখে তালাক দেয় এমন করলেও তালাকহয়ে যাবে।

ويقع طلاق كل زوج بالغ عاقل ولو عبدا أو مكرهاأو سكران 

(ফতুওয়ায়ে শামী ৪/৪৩২)

  • হাসি রহস্য করে তালক দিলে তালাক হয়ে যাবে।

ويقع طلاق كل زوج بالغ عاقل ولو هازلالا يقصد حقيقة كلامه

(ফতুওয়ায়ে শামী ৪/৪৩১)

  • মুখে মুখে তালাক দিলেও তালাক হয়ে যাবে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী মৌখিক তালাক, তালাক নয় ! বরং তালাক লিখিত রুপে দিতে হবে। কিন্তু ইসলাম এটা বলে না।

ويقع طلاق كل زوج بالغ عاقل 

(ফতওুয়ায়ে শামী ৪/৪৩১)

  • কেউ যদি কম বুঝমান হয়, কোথায় কি  বলতে হবে খুব ভালো করে বোঝেনা ! (অর্থাৎ বলদ টাইপের) আর এমন ব্যাক্তি তালাকের মর্ম না বুঝেই তার স্ত্রীকে তালাক দেয় তাতেও তালাক হয়ে যাবে।

ويقع طلاق كل زوج بالغ عاقل ولو سفيها       

(ফতুওয়ায়ে শামী ৪/৪৩১)

বোবা ব্যাক্তি যদি তার ইশারার মাধ্যমে এ কথা বোঝায় যে তার স্ত্রী তালাক, তাতেও তালাক হয়ে যাবে।

ويقع طلاق كل زوج بالغ عاقل ولو أخرس ولو طارئا إن دام للموت به يفتى

(ফতুওয়ায়ে শামী ৪/৪৩৪)

  • কোনো ব্যক্তি যদি ভুলে ,অনিচ্ছায় বা তালাকের মূল অর্থ না বুঝেই ইচ্ছায় তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, অথবা কথা বলতে বলতে অনিচ্ছায় নিজ স্ত্রীকে তালাক দেয় তাতেও তালাক হয়ে যাবে।

و مخطئابأن أراد التكلم بغير الطلاق فجرى على لسانه الطلاق أو تلفظ به غير عالم بمعناه أو غافلا أو ساهيا 

(ফতুয়ায়ে শামী ৪/৪৩৫) 

তালাক না হওয়ার কিছু স্থানঃ

  • পাগল ব্যাক্তি পাগল থাকাবস্থায় তার তালাক পতিত হয় না। 
  • ঘুমন্ত অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয় না।
  • কোনো বাচ্চাকে তার ছোট বেলায় বিবাহ দিয়ে দিলে বাচ্চা থাকাবস্থায় তার তালাক,তালাক হবে না, যত দিন সে বালেগ না হয়।

 لا يقع طلاق المجنون والصبي والنائم 

(ফতুয়ায়ে শামী ৪/৪৪০)

কাবিননামার ১৮ নং ধারাঃ

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত কাবিননামা, যা প্রতিটি বিবাহতে একজন সরকারী অনুমোদিত কাজী সাহেব সাথে করে নিয়ে আসেন, ঐ কাবিননামায় অনেক গুলো ধারা আছে, যার ১৮ নং ধারায় লেখা আছে যে, স্ত্রী চাইলে যে কোনো সময় স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারবে কি না ? অর্থাৎ বিবাহ কার্যসম্পাদনকারী পাত্র যদি নেশা করে, মাদকাসক্ত হয়, অন্যয় কোনো কাজে জড়িত হয়, স্ত্রীকে মারপিট করে অথবা এ ধরনের যে কানো সমস্যায় স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারবে কি না?
এ কলামের নিচে কিছু খালি জায়গা আছে যাতে কাজী সাহেব “‘‘‘ হ্যাঁ ””” লিখে দেয়। অথচ এ বিষয়ে একবারও ছেলের (পাত্রের) কাছে জিজ্ঞাসা করে না !
অথচ ইসলাম বলে তালাক দেওয়ার অধিকার একমাত্র স্বামীর অন্য কারো নয়। বিধায় স্ত্রী তালাক দেওয়ার অধিকার রাখে না। অবশ্য হ্যাঁ ! স্বামী যদি ইচ্ছা করে যে আমি আমার স্ত্রীকে তালাক নেওয়ার ক্ষমতা দিবো ! তাহলে সে এ কাজ করতে পারে যাকে ইসলামের পরিভাষায় তাফয়ীযে তালাক বলা হয়।
তবে এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো; ২টি

  • (১)স্বামী তাকে এ ক্ষমতা দিতে পারবে বিয়ের পর আগে নয় ! যেমনটা বর্তমানে হয়ে থাকে, বিবাহ হওয়ার আগেই কাজী সাহেব কাবিননামার খালি স্থানে হ্যাঁ লিখে দেয় কিন্তু করণীয় বিষয় হলো; আগে বিয়ে হবে পরে ঐ খালি স্থান পূরন হবে যদি ছেলের  (পাত্রের) অনুমতি থাকে।
  • (২) আল্লাহ না করুন, যদি বিয়ের পর যে কোনো কারনে মেয়ের  (পাত্রীর) ডিভোর্স/তালাক নেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে ঐ মেয়েকে মুখে বা লিখিত এ কথা বলতে হবে, আমি তালাক নিলাম। যদি সে বলে; আমি তালাক দিলাম তা হলে তালাক হবে না।

এখানে মন্তব্য করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

লেখক পরিচিতি

নামঃ মুহাম্মদ ইউনুছ আলী
ইফতাঃ দারুল আরকাম মাদরাসা, কামরাঙ্গীচর (২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ)।
তাকমিলঃ জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগ (২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ)।
চলমান শিক্ষাঃ
বি,এ,অনার্সঃ তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ।
ফাজিলঃ ঢাকা আলিয়া, বখশি বাজার।
ইমামঃ নজরুল অয়েল মিলস্, কাঁচপুর।
সিনিয়ার শিক্ষকঃ জামিয়াতুশ শুহাদা দেওয়ানবাগ মাদরাসা, নারায়ণগঞ্জ।
মোবাইলঃ +৮৮০১৯৯৬-১০৩৪৩৫
ই-মেইলঃ mmyounusali@gmail.com

আমাদের অনুসরণ করুন

সর্বশেষ ইউটিউব ভিডিও

সাম্প্রতিক পোস্ট

সাম্প্রতিক পৃষ্ঠা