fbpx

মদ ও জুয়া

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

বিষয়ঃ মদ ও জুয়া
(নির্বাচিত গুরুত্বপূর্ণ আয়াত-এর তরজমা ও তাফসীর)

আয়াতে কারীমাহ্

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ (219

[البقرة: 219]

সরল অনুবাদ

লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, ‘উভয়ের মধ্যে মহাপাপ [১] এবং মানুষের জন্য (যৎকিঞ্চিৎ) উপকারও আছে, কিন্তু উভয়ের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।’[২] লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘(আল্লাহর পথে) তারা কী খরচ করবে?’ বল, ‘যা উদ্বৃত্ত।’[৩] এভাবে আল্লাহ তাঁর সকল নিদর্শন তোমাদের জন্য প্রকাশ করেন যাতে তোমরা চিন্তা কর।

সূরার নাম ঃ আল বাকারা
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ২১৯

সংক্ষিপ্ত তাফসীর

[১] দ্বীনের দৃষ্টিতে এটা মহাপাপ। (যেহেতু এর ফলে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, গালাগালি ও অশ্লীলতার সৃষ্টি হয়। ইবাদতে বাধা সৃষ্টি হয়, অর্থের অপচয় ঘটে এবং বিদ্বেষ, দারিদ্র্য ও লাঞ্ছনার আগমন ঘটে।)
[২] উপকারিতাসমূহের সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে। যেমন, মদপানে সময়িকভাবে শারীরিক স্ফূর্তি, সানন্দ উদ্যম এবং কারো কারো মস্তিষ্ক তেজস্বীতাও আসে। যৌনশক্তি বৃদ্ধি লাভ করে। তাই তার ব্যবহার ব্যাপক হয়। অনুরূপ এর (মদের) ক্রয়-বিক্রয় বড় লাভদায়ক ব্যবসা। জুয়াতেও কখনো কখনো কেউ জিতে যায়, ফলে সে কিছু অর্থ লাভ করে। কিন্তু এই সমূহ উপকারিতা সেই সমূহ ক্ষতি ও ফাসাদের তুলনায় কিছুই নয়; যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও তার দ্বীন-ধর্মের উপর আসে।
আর এই জন্যই বলা হয়েছে, “কিন্তু উভয়ের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।” এই আয়াতে মদ ও জুয়াকে (পরিষ্কারভাবে) হারাম বলা না হলেও তার প্রাথমিক সূচনার উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
এই আয়াত থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এই জানা যায় যে, প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে কিছু না কিছু লাভ থাকেই, তাতে তা যতই খারাপ জিনিস হোক না কেন। যেমন রেডিও, টিভি এবং এই ধরনের আরো আবিষ্কৃত আধুনিক জিনিস। মানুষ তার কিছু কিছু লাভের কথা উল্লেখ করে আত্মপ্রতারণা করে থাকে। কিন্তু বিবেচনা করা উচিত যে, লাভ ও নোকসানের মধ্যে কোনটার ভাগ বেশী।
বিশেষতঃ দ্বীন, ঈমান এবং আখলাক-চরিত্রের দিক দিয়ে। যদি দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে তার নোকসান ও ক্ষতির দিক বেশী হয়, তাহলে সামান্য পার্থিব লাভের জন্য তা জায়েয সাব্যস্ত করা যাবে না।
[৩] এই অর্থের দিক দিয়ে এটা একটি নৈতিক নির্দেশ অথবা এই নির্দেশ ইসলামের প্রথম পর্যায়ে ছিল। যাকাত ফরয হওয়ার পর এর উপর আমল আর জরুরী নয়। তবে উত্তম অবশ্যই বটে। কিংবা العَفو এর অর্থ হল, “যা সহজভাবে ও অনায়াসে হয় এবং অন্তরে ভারী অনুভূত না হয়।” ইসলাম অবশ্যই (আল্লাহর পথে) ব্যয় করার প্রতি বড় উৎসাহ প্রদান করেছে, তবে এ ব্যাপারে মধ্যপন্থার খেয়াল রেখে
প্রথমতঃ স্বীয় অধীনস্থ ব্যক্তিদের দেখাশোনা এবং তাদের প্রয়োজন পূরণকে প্রাধান্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ এমন মুক্তহস্তে ব্যয় করতে নিষেধ করেছে, যাতে কাল তোমাকে ও তোমার পরিবারের লোকদেরকে অন্যের দ্বারস্থ হতে না হয়।

আয়াতে কারীমাহ্

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ وَلَا جُنُبًا إِلَّا عَابِرِي سَبِيلٍ حَتَّى تَغْتَسِلُوا وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَفُوًّا غَفُورًا (43

[النساء: 43]

সরল অনুবাদ

হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নেশার অবস্থায় নামাযের নিকটবর্তী হয়ো না,[১] যতক্ষণ না তোমরা কি বলছ, তা বুঝতে পার এবং অপবিত্র অবস্থাতেও নয়, যদি তোমরা পথচারী না হও,[২] যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা গোসল কর।[৩] আর যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা সফরে থাক অথবা তোমাদের কেউ পায়খানা (শৌচস্থান) হতে আসে অথবা তোমরা নারী-সম্ভোগ কর এবং পানি না পাও, তাহলে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর; (তা) মুখে ও হাতে বুলিয়ে নাও।[৪] নিশ্চয় আল্লাহ পরম মার্জনাকারী, অত্যন্ত ক্ষমাশীল।

সূরার নাম ঃ আন নিসা
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ৪৩

সংক্ষিপ্ত তাফসীর

[১] এই নির্দেশ ছিল ঐ সময়ে, যখন মদ হারাম হওয়ার কথা তখনো নাযিল হয়নি। কোন এক খাবার দাওয়াতে মদ পানের পর নামাযে দাঁড়ালে নেশার ঘোরে ইমাম সাহেব কুরআন পড়তে ভুল করেন। ফলে এই আয়াত অবতীর্ণ করে বলা হয় যে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামায পড়ো না। অর্থাৎ, তখন কেবল নামাযের নিকটবর্তী সময়ে মদপান করতে নিষেধ করা হয়। মদপানের পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ও তার হারাম হওয়ার নির্দেশ পরে নাযিল হয়। (এটা হল মদের ব্যাপারে দ্বিতীয় নির্দেশ যা শর্ত-সাপেক্ষ।)
[২] এর অর্থ এই নয় যে, পথে বা সফরে থাকা অবস্থায় পানি না পাওয়া গেলে অপবিত্র অবস্থাতেই নামায পড়ে নাও (যেমন অনেকে মনে করে), বরং অধিকাংশ উলামাদের নিকট এর অর্থ হল, অপবিত্র অবস্থায় তোমরা মসজিদে বসো না, তবে মসজিদ হয়ে কোথাও যাওয়ার দরকার হলে যেতে পার। কোন কোন সাহাবীর ঘর এমন ছিল যে, সেখানে মসজিদের সীমানা হয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁদের কোন উপায় ছিল না। আর এই কারণেই মসজিদ-সীমানার ভিতর হয়ে অতিক্রম করে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।
(ইবনে কাসীর) মুসাফিরের বিধান তো পরে আসবে।
[৩] অর্থাৎ, অপবিত্র অবস্থাতেও নামায পড়বে না। কারণ, নামাযের জন্য পবিত্রতা অত্যাবশ্যক।
[৪] এখানের যাদের জন্য তায়াম্মুম বিধেয়, তাদের কথা বলা হচ্ছেঃ
(ক) অসুস্থ ব্যক্তি বলতে এমন রোগীকে বুঝানো হয়েছে, যে ওযু করলে ক্ষতি অথবা রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা করে।
(খ) সফর বা মুসাফির সাধারণ শব্দ তাতে সফর লম্বা হোক বা সংক্ষিপ্ত; পানি না পেলে তায়াম্মুম করার অনুমতি আছে। পানি না পাওয়া গেলে তায়াম্মুম করার অনুমতি তো গৃহবাসী (অমুসাফির)-এরও আছে, কিন্তু রোগী ও মুসাফিরের এই ধরনের প্রয়োজন সাধারণতঃ বেশী দেখা দেয়, তাই বিশেষ করে তাদের জন্য এই অনুমতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
(গ) পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন পূরণকারী এবং
(ঘ) স্ত্রীর সাথে সহবাসকারীও যদি পানি না পায়, তাহলে তাদের জন্যও তায়াম্মুম করে নামায পড়ার অনুমতি আছে।
আর তায়াম্মুম করার নিয়ম হল,
পবিত্র মাটিতে একবার হাত দু’টিকে মেরে উভয় হাতকে কবজি পর্যন্ত বুলিয়ে নিয়ে (কনুই পর্যন্ত নয়) মুখে বুলিয়ে নিবে।
নবী করীম (সাঃ) তায়াম্মুম সম্পর্কে বলেছেন, “উভয় হাত এবং মুখমন্ডলের জন্য একবার মাটিতে মারতে হবে।”
(মুসনাদ আহমাদ ৪/২৬৩)
[صَعِيْدًا طَيِّبًا] এর অর্থ হল, পবিত্র মাটি। মাটি থেকে উৎপন্ন প্রতিটি জিনিস নয়, যেমন অনেকে মনে করে।
হাদীসে এটা আরো পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছেঃ
((جُعِلَتْ تُرْبَتُهَا لَنَا طَهُوْرًا إِذَا لَمْ نَجِدِ المَاءَ)) “পানি না পাওয়া গেলে যমীনের মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
(মুসলিম ৫২২নং)

আয়াতে কারীমাহ্

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (90

[المائدة: 90]

সরল অনুবাদ

হে বিশ্বাসীগণ! মদ, জুয়া আর মূর্তী ও ভাগ্য নির্ধারক তীর ঘৃণিত শয়তানী কাজ, তোমরা তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সাফল্যমন্ডিত হতে পার।

সূরার নাম ঃ আল মায়িদাহ
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ৯০

সংক্ষিপ্ত তাফসীর

এটি মদের ব্যাপারে তৃতীয় নির্দেশ। প্রথম ও দ্বিতীয় নির্দেশে পরিষ্কারভাবে নিষেধ করা হয়নি। কিন্তু এখানে মদ ও তার সাথে জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ণায়ক তীরকে অপবিত্র বা ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানী বিষয় বলে স্পষ্ট ভাষায় তা থেকে দূরে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া এ আয়াতে মদ ও জুয়ার অতিরিক্ত অপকারিতা বর্ণনা করে প্রশ্ন করা হয়েছে, তবুও কি তোমরা বিরত হবে না? এ থেকে উদ্দেশ্য ঈমানদারকে পরীক্ষা করা। সুতরাং যাঁরা মু’মিন ছিলেন, তাঁরা আল্লাহর উদ্দেশ্য বুঝে গেলেন এবং তা যে নিশ্চিত হারাম, তা মেনে নিয়ে বললেন, ‘আমরা বিরত হলাম, হে আমাদের প্রতিপালক!’
(আহমাদ ২/৩৫১)
কিন্তু সাম্প্রতিক কালের তথাকথিত কিছু ‘চিন্তাবিদ’ বলেন যে, ‘মদ হারাম কোথায় বলা হয়েছে?!’ এমন চিন্তা-বুদ্ধির জন্য তো রোদন করতে হয়। মদকে অপবিত্র বা ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানী বিষয় গণ্য করে তা হতে দূরে থাকতে আদেশ দেওয়া এবং দূরে থাকাকে সফলতার কারণ গণ্য করা ঐ ‘মুজতাহিদ’দের নিকট হারাম হওয়ার জন্য (দলীল হিসাবে) যথেষ্ট নয়! যার মতলব হল, আল্লাহর নিকট অপবিত্র বস্তুও বৈধ, শয়তানী কাজও বৈধ। যে জিনিস থেকে আল্লাহ দূরে থাকতে বলেন, সে জিনিসও হালাল। যে কাজ সম্পাদন করাকে অসফলতা ও বর্জন করাকে সফলতার কারণ গণ্য করা হয়, তাও বৈধ! সুতরাং ‘ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিঊন।’

আয়াতে কারীমাহ্

إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ (91

[المائدة: 91]

সরল অনুবাদ

শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামাযে বাধা দিতে চায়![১] অতএব তোমরা কি নিবৃত্ত হবে না?

সূরার নাম ঃ আল মায়িদাহ
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ৯১

সংক্ষিপ্ত তাফসীর

[১] এ হল মদ ও জুয়ার অতিরিক্ত সামাজিক ও ধর্মীয় অপকারিতা; যা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এই জন্য মদকে বহু মন্দের চাবিকাঠি বা প্রধান পাপকর্ম বলা হয়। আর জুয়াও এমন নিকৃষ্ট খেলা যে, মানুষকে নিমেষে কপর্দকশূন্য করে ফেলে এবং আমীরজাদা ও বনেদী বড়লোককেও নিঃসব গরীব বানিয়ে ছাড়ে। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমীন।