মোজাদ্দেদ আলফেসানী আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) এর জন্ম ও বংশ পরিচয় :
হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি এর নাম আবুল বারাকাত বদরুদ্দীন, আহমদ সিরহিন্দি। তিনি ৯৭১ হিজরি মোতাবেক ১৫৬১ খৃস্টাব্দে ভারতের পাঞ্জাব শহরের সিরহিন্দে জন্মগ্রহন করেন।পিতার নাম আব্দুল আহাদ। তার বংশ হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে । এ জন্য তিনি গর্ব করতেন ।
শিক্ষা-দীক্ষা:
হযরত মুজাদ্দিদ আহমদ সিরহিন্দি রহ. স্বীয় পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি পবিত্র কোরআনুল কারীমের হেফজ সম্পন্ন করেন। অতপর তিনি চলে যান শিয়ালকোটের বিখ্যাত আলেম কামাল কাশ্মীরীর কাছে। সেখানে তিনি হাদীস, ফিকহ, তাফসীর ও আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। জ্ঞানার্জনের অদম্য আগ্রহ তাকে পুনরায় রাহতাস ও জৌনপুরে নিয়ে যায়।তথায় তিনি আবুল ফজল ও আবুল ফায়জের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। সেখানে থাকাবস্থায় তিনি অতি নিকট থেকে সমসাময়িক চিন্তাধারা, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড দেখার সুযোগ পান। সেখানে থাকাবস্থায়ই স্বীয় পিতা তাকে সিরহিন্দে ডেকে পাঠান। তিনি স্বীয় পিতার কাছ থেকে চিশতিয়া তরীকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন। ওই সময় হয়তো তিনি সোহরাওয়ার্দিয়া ও কাদরিয়া তরীকার দীক্ষাও লাভ করেছিলেন। তার উস্তাদ শাইখ ইয়াকুব কাশ্মীরীর রহ. এর মাধ্যমে তিনি আরো একটি তরীকার শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কোনটার দ্বারাই তিনি পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। ১০০৮ হিজরিতে হজযাত্রায় দিল্লি পৌঁছলে তার বন্ধু, খাজা বাকীবিল্লাহর কামালাত সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। শাইখের প্রতি অন্তরে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। তিনি তার খেদমতে হাজির হন। খাজা সাহেবের সান্নিধ্যে অল্পদিন অবস্থান করার দ্বারা আহমদ সিরহিন্দির বহুদিনের আধ্যাত্মিক অতৃপ্তির অবসান ঘটে। অপর দিকে খাজা সাহেব আহমদ সিরহিন্দির সততা, সরলতা, সুন্নতের অনুসরণ ও শরীয়তের পালন দেখে অভিভূত হন। তারপর তিনি স্বীয় শাইখের নির্দেশে নিজ এলাকা সিরহিন্দে ফিরে আসেন।

সম্রাট আকবরের দীনে ইলাহির বিরুদ্ধে আন্দোলন :
হযরত মুজাদ্দিদ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) এর জন্মের সময় বাদশা আকবর দীনে ইলাহী নামে এক নতুন মনগড়া ধর্ম প্রবর্তন করছিলো। শিক্ষাগ্রহণের সময়ে তিনি খুব কাছে থেকে আকবর ও তার ইসলাম বিরোধী নীতিকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। কর্মজীবনে আসার পর তার কাছে আরো স্পষ্ট হয় যে, রাষ্ট্র কীভাবে দীন ইসলামের বিরোধীতায় অবতীর্ণ হয়েছে। এসব বুঝার পর, তার ভেতর লুকিয়ে থাকা ঈমানী সুপ্ত আগুন জ্বলে ওঠে। পরিস্কার হয়ে ওঠে জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। অবস্থার পরিবর্তনই এখন তার মূল টার্গেটে পরিণত হয়। ফিকিরের মূল জায়গা দখল করে নেয়, হিন্দুস্তানে মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যতের চিন্তা। এহেন নাযুক মুহূর্তে অন্যদের ন্যায় তিনি দর্শকের ভূমিকা পালন না করে, অবতীর্ণ হলেন বিপ্লবের ময়দানে। ঠিক করলেন কর্মপন্থা।দাওয়াত ও ইসলাহের ময়দানে শাইখ আলফে সানী (রাহ.) কঠোর কোনো কর্মসূচি দেননি। প্রথমে তিনি নিজের ভেতর থেকে সমস্ত রকমের জাগতিক স্বার্থকে বের করলেন। একমাত্র সংশোধন ও ইসলাহের নিয়তে রাজ্যের কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর তিনি রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের কাছে যাতায়াত শুরু করলেন। শুরুতে তাকে অন্যদের মতোই ধান্দাবাজ মনে করলেও খুব দ্রুতই তার ব্যাপারে তাদের ধারণা পাল্টে যেতে থাকে। তারা দেখতে পেলো, তিনি শুধু রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ; বরং তার ভেতর রয়েছে মনুষ্যত্বের যাবতীয় গুণাবলী। তার উপর বস্তুর কোনো কর্তৃত্ব চলে না; তিনিই বস্তুর উপর কর্তৃত্ব করেন। তখন তারা শাইখের সামনে নিজেদেরকে সোপর্দ করে দিলো। তার এই তৎপরতার সময় সম্রাট আকবর জীবিত ছিলেন। এর কিছু দিন পরেই আকবর মারা যায় আর ক্ষমতায় বসে সম্রাট জাহাঙ্গীর।

আহমদ সিরহিন্দি (রাহ.) এর কারাজীবন:
সম্রাট জাহাঙ্গীর, আহমদ সিরহিন্দিকে আকবরের তুলনায় বেশি সম্মান করতো। কিন্তু তার পাশের লোকেরা আহমদ সিরহিন্দিকে ভালো চোখে দেখতো না। তাই ওরা সম্রাটকে কানপড়া দিতে শুরু করলো। পরামর্শ দিলো, তাকে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। এ জন্য সম্রাট একবার তাকে দরবারে ডেকে পাঠালো। ওই সময় নিয়ম ছিলো, যারা রাজ দরবারে আসবে সম্রাটকে সম্মানের সেজদা করবে। এ ব্যাপারে ইসলামের রীতি হচ্ছে, আগন্তুক সালাম দিবে, সেজদা নয়। তাই আহমদ সিরহিন্দি দরবারে প্রবেশের পর সেজদা না করে, সালাম দিলেন। এতে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে জেলে বন্দি করে। জেলে আটক করা আহমদ সিরহিন্দি এ সুযোগকে কাজে লাগালেন। জেলখানায় তিনি দাওয়াতি কাজ শুরু করে দিলেন। এতে কয়েকজন অমুসলিম তার হাতে মুসলমান হয়। অসংখ্য অপরাধী তওবা করে গোনাহ থেকে ফিরে আসে। ইতোমধ্যে শাইখ এর মুরিদরা মুক্তির জন্য বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করেন এবং সম্রাট নিজেও স্বীয় কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আহমদ সিরহিন্দিকে জেল থেকে মুক্তি দেয়। মুক্তির পর রমজান মাসে তিনি সম্রাটের নিকট কাটান। সম্রাট শাইখের পেছনে তারাবির নামাজ আদায় করেন। ওই সময় তিনি সম্রাটকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেন। এভাবে আবারো রাজ পরিবার দীনের পথে আসতে থাকে। যার সর্বশেষ ফলাফল হচ্ছে, বাদশা আলমগিরের মতো ন্যায়পরায়ন, আল্লাহভীরু শাসক।

মোজাদ্দেদ আলফেসানী আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) এর রচনাবলী:
তার এর উল্লেখযোগ্য রচনা হচ্ছে-
- ১. আল মাবদা ওয়াল-মাআদ
- ২. রিসালা-ই তাহলীলিয়্যা
- ৩. রিসালা ফী ইছবাতিন নাবুওয়া ওয়া আদাবিল মুরীদিন
- ৪. রাদ্দে রাওয়াফিজ
- ৫. হযরত মুজাদ্দিদ আহমদ সিরহিন্দি (রাহ.) এর সর্ববৃহৎ ও জ্ঞানসমৃদ্ধ অবদান হচ্ছে মাকতূবাত। অনেকের ধারণা, মাওলানা রুমী (রাহ.) এর মাছনবীর পর আহমদ সিরহিন্দি (রাহ.) এর মাকতূবাতই ইসলামী দর্শন, নিগূঢ় তত্ত, শরীয়ত ও তরীকতের বড় ভাণ্ডার।
মৃত্যু:
হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী আহমদ সিরহিন্দি (রাহ.) এর মিশন ছিলো সম্রাট আকবরের দীনে ইলাহীকে প্রতিহত করে, তদ্বস্থলে ইসলামী আদর্শের পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তার প্রচেষ্ঠার ফলে আকবরের পরবর্তী সম্রাটগণ ইসলামের দিকে ধাবিত হতে থাকে। বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর হচ্ছেন যার উজ্জ্বল নমুনা। বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীর শুধু একজন সম্রাট বা বাদশাই ছিলেন না বরং একজন বিজ্ঞ আলেমও ছিলেন। আহমদ সিরহিন্দি, সিরহিন্দে ১০ ই ডিসেম্বর ১৬২৪ খৃস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা , তিনি যেন তাকে জান্নাতের উঁচু স্থান দান করেন।
4 Responses
Nice 🙂
খুব ই সাধারণমানের একটি লিখা। লেখকের রূহ যে তরীকত ও মারেফতবিহীন একটি সাধারণ রূহ তা সম্পূর্ণ স্পস্ট। হাজার বছরের যিনি মুজাদ্দেদ, শরীয়ত ও তরীকতের যিনি বাদশাহ, আওলিয়াকূলের যিনি সরতাজ, শিরোমণি, তাজেদার। উনার ব্যাপারে এমন আদবহীনভাবে সম্মোধন করা নিতান্তই উনাকে অপমান করা যদিও, উনাকে যথাযথ সম্মান করার যোগ্যতা একজন সাধারণ মানের আওলিয়ার (র:) ক্ষেত্রেও অসম্ভব কিন্তু, আরো গাম্ভীর্যপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ ও গভীরতাসমৃদ্ধ লিখা হওয়া দরকার ছিলো এমন একটি পাবলিক প্লাটফর্মে।
মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ
আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনের খাদেম হিসেবে কবুল করুন আমিন
আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ