সালাত|নামায
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
বিষয়ঃ সালাত (নামায)
(নির্বাচিত গুরুত্বপূর্ণ আয়াত-এর তরজমা ও তাফসীর)
আয়াতে কারীমাহ্
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ (17)
وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ (18
[الروم: 17، 18]
সরল অনুবাদ
- অতএব তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যখন তোমরা সন্ধ্যায় উপনীত হও আর সকালে,
- এবং বিকালে ও দুপুরে। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে সকল প্রশংসা তাঁরই।
সূরার নাম ঃ রুম
অবর্তীণ ঃ মক্কায়
আয়াত নম্বরঃ ১৭ এবং ১৮
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
সন্ধ্যা ও সকাল হল রাতের অন্ধকার ও দিনের আলোর প্রারম্ভ। এশা খুব অন্ধকার এবং যোহর খুব উজ্জ্বলতার সময় হয়ে থাকে। অতএব ঐ সত্তা অতি পবিত্র যিনি উক্ত সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা এবং যিনি সেই বিভিন্ন সময়ের মধ্যে আলাদা আলাদা উপকারিতা রেখেছেন। এখানে ‘তাসবীহ’র অর্থ হল নামায। উক্ত দুটি আয়াতে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে তা হল, পাঁচ অক্ত নামাযের সময়। تُمسُون (সন্ধ্যা) শব্দে মাগরিব-এশা, تُصبِحُون (ভোর) শব্দে ফজর عَشِيًا (বিকাল) শব্দে আসর এবং تُظهِرون (দুপুর) শব্দে যোহর নামাযের সময় উল্লেখ হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর)
আয়াতে কারীমাহ্
وَأَنْ أَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَاتَّقُوهُ وَهُوَ الَّذِي إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ (72
[الأنعام: 72]
সরল অনুবাদ
( আরও আদেশ করা হয়েছে যে,) তোমরা কায়েম কর সালাত এবং তাঁকে (আল্লাহকে) ভয় করো আর তাঁরই কাছে তোমাদের সমবেত করা হবে।
সূরার নাম ঃ আন-আ’ম
অবর্তীণ ঃ মক্কায়
আয়াত নম্বরঃ ৭২
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
وَأَنْ أَقِيْمُوْا এর সংযোগ হল لِنُسْلِمَ এর সাথে। অর্থাৎ, আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন বিশ্বের প্রতিপালকের অনুগত হয়ে যাই। আর আমরা যেন নামায কায়েম করি এবং তাঁকে ভয় করি। আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার পর সবচেয়ে বড় নির্দেশ নামায প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশই দেওয়া হয়েছে। এতে নামাযের গুরুত্ব সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আর এর পর রয়েছে আল্লাহভীরুতার নির্দেশ। কারণ, নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়া আল্লাহভীরুতা ও নম্রতা ব্যতীত সম্ভব নয়। তিনি বলেন, {وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ} বিনীতগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট নিশ্চিতভাবে এ কঠিন।
(সূরা বাক্বারাহ ২:৪৫)
আয়াতে কারীমাহ্
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ
[المائدة: 91]
সরল অনুবাদ
অবশ্যই শয়তান তোমাদের মধ্যে মদ ও জুয়া দ্বারা শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং সে তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাতে বাধা দিতে চায় ? অতএব তোমরা কি বিরক্ত হবে না ?
সূরার নাম ঃ মায়িদাহ্
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ৯১
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
এ হল মদ ও জুয়ার অতিরিক্ত সামাজিক ও ধর্মীয় অপকারিতা; যা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এই জন্য মদকে বহু মন্দের চাবিকাঠি বা প্রধান পাপকর্ম বলা হয়। আর জুয়াও এমন নিকৃষ্ট খেলা যে, মানুষকে নিমেষে কপর্দকশূন্য করে ফেলে এবং আমীরজাদা ও বনেদী বড়লোককেও নিঃসব গরীব বানিয়ে ছাড়ে। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমীন।
আয়াতে কারীমাহ্
فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ (11
[التوبة: 11]
সরল অনুবাদ
আর তারা যদি তওবা করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়, তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই। আমি বিশদভাবে বিবৃত করে নিদর্শনসমূহ জ্ঞানী লোকদের জন্য।
সূরার নাম ঃ তাওবাহ্
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ১১
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
নামায হল তাওহীদ ও রিসালতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করার পর ইসলামের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা আল্লাহর হক। তাতে আল্লাহর ইবাদতের বিভিন্ন দিক রয়েছে। এতে রয়েছে হাত বেঁধে কিয়াম, রুকূ ও সিজদা। এতে রয়েছে দু’আ ও মুনাজাত, আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা এবং নিজের মিনতি ও অসহায়তার প্রকাশ। ইবাদতের এই সমস্ত প্রকার ও ধরন কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। নামাযের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও ফরযকৃত রুকন হল যাকাত। যাতে আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে বান্দারও হক শামিল রয়েছে। যাকাতের অর্থ দ্বারা সমাজের ও বিশেষ করে যাকাতদাতার আত্মীয় গরীব-মিসকীন ও অক্ষম লোকদের প্রয়োজন মিটে থাকে। এই জন্য হাদীসে দুই সাক্ষ্য দানের পর উক্ত দু’টি বিষয়কে পরিষ্কার করে বর্ণনা করা হয়েছে। নবী (সাঃ) বলেছেন, “আমাকে আদেশ করা হয়েছে যে, লোকদের বিরুদ্ধে আমি যেন ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকি, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সাক্ষী দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল। আর নামায কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে।” (বুখারী ঈমান অধ্যায়, মুসলিম ঈমান অধ্যায়) আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি যাকাত প্রদান করে না, তার নামাযও গ্রহণযোগ্য নয়।’
(আহসানুল বায়ান তাফসীর)
আয়াতে কারীমাহ্
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (162
[الأنعام: 162]
সরল অনুবাদ
বল, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু, (সবকিছুই) বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই (নিবেদিত)
সূরার নাম ঃ আন-আ’ম
অবর্তীণ ঃ মক্কায়
আয়াত নম্বরঃ ১৬২
আয়াতে কারীমাহ্
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ (45
[البقرة: 45]
সরল অনুবাদ
তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর আর তা আল্লাহভীরু ব্যক্তিবর্গ ছাড়া অন্য সকলের কাছে নিশ্চিতভাবে কঠিন।
সূরার নাম ঃ বাকারাহ্
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ৪৫
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
ধৈর্য এবং নামায প্রত্যেক আল্লাহভীরু লোকের বড় হাতিয়ার। নামাযের মাধ্যমে একজন মু’মিনের সম্পর্ক মহান আল্লাহর সাথে বলিষ্ঠ হয়। এরই দ্বারা সে আল্লাহর নিকট থেকে শক্তি ও সাহায্য লাভ করে। ধৈর্যের মাধ্যমে কার্যে সুদৃঢ় এবং দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত থাকার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। হাদীসে এসেছে, “নবী কারীম (সাঃ)-এর সামনে যখন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসে উপস্থিত হত, তখন তিনি সত্বর নামাযের শরণাপন্ন হতেন।” (আহমদ, আবূ দাউদ, ফাতহুল ক্বাদীর)
আয়াতে কারীমাহ্
حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ (238
[البقرة: 238]
সরল অনুবাদ
সমস্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও।
সূরার নাম ঃ বাকারাহ্
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ২৩৮
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
মধ্যবর্তী নামায বলতে আসরের নামাযকে বুঝানো হয়েছে। রসূল (সাঃ)-এর সেই হাদীস দ্বারা এটা নির্দিষ্ট, যাতে খন্দক যুদ্ধের দিন তিনি ‘সালাতে উসত্বা’কে আসরের নামায বলে অভিহিত করেছেন। (বুখারী ২৯৩১-মুসলিম ৬২৭নং)
(আহসানুল বায়ান তাফসীর)
আয়াতে কারীমাহ্
فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالًا أَوْ رُكْبَانًا فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ (239
[البقرة: 239]
সরল অনুবাদ
অতঃপর যদি তোমাদের কারো ব্যাপারে ভয় থাকে, তাহলে পদচারী অবস্থাতেই পড়ে নাও অথবা সওয়ারীর উপরে। তারপর যখন তোমরা নিরাপত্তা পাবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমাদের শেখানো হয়েছে, যা তোমরা ইতিপূর্বে জানতে না।
সূরার নাম ঃ বাকারাহ্
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ২৩৯
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
অর্থাৎ, শত্রুর ভয়ের সময় যেভাবে সম্ভব; হাঁটতে হাঁটতে অথবা বাহনের উপর বসে নামায পড়ে নাও। অতঃপর যখন ভয়ের অবস্থা দূর হয়ে যাবে, তখন পুনরায় সেইভাবে নামায পড়, যেভাবে তোমাদেরকে শিখানো হয়েছে।
(আহসানুল বায়ান তাফসীর)
আয়াতে কারীমাহ্
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ (153
[البقرة: 153]
সরল অনুবাদ
হে মু’মিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয় মহান আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।
সূরার নাম ঃ বাকারাহ্
অবর্তীণ ঃ মদীনায়
আয়াত নম্বরঃ ১৫৩
সংক্ষিপ্ত তাফসীর
মানুষের দু’টি অবস্থা হয়, আরাম ও স্বস্তি এবং কষ্ট ও অস্বস্তি। আরাম ও স্বস্তির সময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং কষ্ট ও অস্বস্তির সময় ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনার তাকীদ করা হয়েছে। হাদীসে এসেছে, “মু’মিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক। তার জন্য আনন্দের কোন কিছু হলে, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর ক্ষতিকর কোন কিছু হলে, সে ধৈর্য ধারণ করে। এই উভয় অবস্থা তার জন্য কল্যাণকর।” (মুসলিম ২৯৯৯নং) ধৈর্য দু’প্রকারের। প্রথম হল, হারাম ও পাপ কাজ ত্যাগ করা ও তা থেকে দূরে থাকার উপর এবং লোভনীয় (অবৈধ) জিনিস বর্জন ও সাময়িক সুখ ত্যাগ করার উপর ধৈর্য ধারণ করা। দ্বিতীয় হল, আল্লাহর নির্দেশাবলী পালন করতে গিয়ে যে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তা ধৈর্য ও সংযমের সাথে সহ্য করা। কেউ কেউ সবর ও ধৈর্যের ব্যাখ্যা এইভাবে করেছেন, আল্লাহর পছন্দনীয় কর্মসমূহ সম্পাদন করা; তাতে দেহ ও আত্মায় যতই কষ্ট অনুভব হোক না কেন। আর আল্লাহর অপছন্দনীয় কর্মসমূহ থেকে দূরে থাকা; তাতে প্রবৃত্তি ও কামনা তাকে সেদিকে যতই আকৃষ্ট করুক না কেন।
(ইবনে কাসীর)