fbpx
সকল ক্ষমতা আল্লাহর। তবে আল্লাহ্ কিছু বস্তুর মধ্যে কিছু ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন যা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে থাকে। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন তাহলে সেই ক্ষমতাও আবার স্থীর ও বন্ধ হয়ে যায়।
ইসলাম ধর্মে ছোঁয়াচে রোগের বিশ্বাস

সূচিপত্র

ইসলাম ধর্মে ছোঁয়াচে রোগের বিশ্বাস

মাওলানা রফিকুল ইসলাম (নওয়াপাড়া)
সকল ক্ষমতা আল্লাহর। তবে আল্লাহ্ কিছু বস্তুর মধ্যে কিছু ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন যা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে থাকে। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন তাহলে সেই ক্ষমতাও আবার স্থীর ও বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে অনেকেই জানতে চাচ্ছেন যে, ইসলামে ছোঁয়াচে রোগের বিশ্বাস ও রোগ সংক্রমণের ধারণা রাখা কুফুরী আকীদা কি না ?

এ প্রশ্নটি আসলে কেবল করোনার বিষয়ে নয়, বরং সকল ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বক্ষমাণ প্রবন্ধে বিষয়টির শরয়ী সমাধান তুলে ধরা হবে। অর্থাৎ ইসলামে ছোঁয়াচে রোগের ধারণা রাখা যাবে কি না ? রোগ সংক্রমণ করে এমন বিশ্বাস রাখা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কি না ?

  • ১) ইসলামের একটি স্বীকৃত নীতি হলো, সকল ক্ষমতার মালিক  একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোন ক্ষমতা নেই। না আছে কোন মানুষের, না কোন বস্তুর।

মুসলিম মাত্রই এ বিশ্বাস রাখা আবশ্যক ও অপরিহার্য। এ বিশ্বাস ছাড়া কোন ব্যক্তি মুসলমানই হতে পারে না।

সকল ক্ষমতা আল্লাহর এ বিষয়ে কিছু আয়াত;

আল্লাহ তা’লা বলেন;

১. “أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا ”  অর্থ: সকল ক্ষমতা আল্লাহর।
(সূরা বাকারা, আয়াত:১৬৫)

২. “لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ  অর্থ: আসমান- যমীন ও এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিকানা আল্লাহর। আর তিনি সবকিছু করতে সক্ষম।
(সূরা মায়েদা, আয়াত: ১২০)

৩.“ مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّه ”  অর্থ: আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদ আসে না। 
(সূরা তাগাবুন, আয়াত:১১)

ঠিক একইভাবে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে রোগে আক্রান্ত হওয়াও আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ চাইলেই কেবল ঐ ব্যক্তি রোগে আক্রান্ত হবে, অন্যথায় আক্রান্ত হবে না।

রোগের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই অন্যকে আক্রান্ত করার।

জাহেলী যুগে মানুষ মনে করতো রোগের নিজস্ব ক্ষমতা আছে। নিজ ক্ষমতায় সে অন্যত্র সংক্রমণ করে। এই বিশ্বাসকে হাদীসে খন্ডন ও অপনোদন করা হয়েছে।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ” لا عدوى “ ‘রোগ-ব্যধি (তার নিজস্ব ক্ষমতায়) একজনের দেহ থেকে অন্য জনের দেহে সংক্রমণ করে না।’
(সহীহ বুখারী, পৃষ্ঠা ১১২০, হাদীস নং:৫৭০৭)

এ হাদীসে মূলত এ বিশ্বাসের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, রোগের নিজস্ব ক্ষমতা নেই অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার বরং সকল ক্ষমতা আল্লাহ তা’লার।
(আল-আরফুশ শাযী:২:৩১৫), আল-ফাজরুস সাতে’:৫৭০৭, আল-মিন্নাতুল কুবরা:১:২৬৫،, তুহফাতুল আহওয়াযী:৫:৪৩৯, তুহফাতুল আতীব্বা মিন কালামি খায়রিল আম্বীয়া:১:১৪, উমদাতুল ক্বারী, ৩১:৩২১, আউনুল ওয়াদুদ,১:১৬৫, ফয়যুল বারী, ৬:৫১)

আল্লামা ইবনুস সালাহ, তাকীয়ুদ্দীন সুবকী রহ. প্রমুখ উলামায়ে কেরাম এ মতটি গ্রহন করেছেন।

  • ২) তবে আল্লাহ তা’লা নিজ ইচ্ছায় বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে কিছু শক্তি দিয়ে রেখেছেন ;

যেমন:

১. আগুনের মধ্যে আল্লাহ পুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন । আগুন বিভিন্ন বস্তুকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়  তবে এটা আগুনের নিজস্ব শক্তি নয় বরং আল্লাহর দেয়া শক্তি।

২. ছুরির মধ্যে আল্লাহ ক্ষমতা দিয়েছেন কেটে ফেলার তাইতো ছুরি বিভিন্ন বস্তু কেটে ফেলে তবে এটা ছুরির নিজস্ব কোন ক্ষমতা নয় বরং আল্লাহর দেয়া শক্তি।

  • ৩) এ শক্তি আল্লাহর ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ;

এই প্রদেয় শক্তিও আবার আল্লাহর ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাই আল্লাহ ইচ্ছা না করলে ছুরি ও আগুনের শক্তি কার্যকর হবে না। এজন্যই আগুন ইব্রাহিম আ:কে পোড়াতে পারে নি।

আল্লাহ তা’লা বলেন;

” قُلْنَا يَانَارُ كُونِي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلَى إِبْرَاهِيمَ ”

অর্থাৎ আমি ( আল্লাহ) বললাম: হে আগুন! তুমি ইব্রাহিমের জন্য ঠান্ডা ও আরামদায়ক হয়ে যাও।
(সূরা আম্বিয়া:৬৯)

তখন আগুন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো এবং তা ইব্রাহিম আ: কে পোড়াতে পারে নি। কারণ সেখানে আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো না। তদ্রুপ ছুরি ইসমাঈল আ: কে কাটতে পারে নি। কারণ সেখানে আল্লাহ হুকুম ও ইচ্ছা ছিলো না।

আল্লাহ তা’লা বলেন;
 ” فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ “ অর্থাৎ ইব্রাহিম ও ইসমাঈল আ: আল্লাহর আদেশ মানলেন ও ইব্রাহিম আ: ইসমাঈল আ:কে কাত করে শোয়ালেন (কুরবানী করার জন্য)।
(সুরা সাফ্ফাত:১০৩)

তাফসীরে কুরতুবীতে (১৫:১২০) বলা হয়েছে ;
যতোবারই ইব্রাহিম আ: ছুরি দিয়ে পুত্র ইসমাঈল আ: কে যবেহ করতে যাচ্ছিলেন ততবারই ছুরি গায়েবীভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছিলো। কারণ সেখানে আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ছিলো না। সুতরাং এরই আলোকে বলা যায় আল্লাহ যদি চান রোগ অন্যত্র সংক্রমণ করতে পারে। আল্লাহ না চাইলে পারে না।

  • ৪) রোগ সংক্রমণ নিয়ে গবেষকদের মাঝে মতের ভিন্নতা ;

আসলে রোগ একজন থেকে অন্যত্র সংক্রমণ করে কি না এ বিষয়ে গবেষকদের মাঝে কিছু মতানৈক্য রয়েছে। যথা:

১. চিকিৎসকদের মতে, রোগ সংক্রমণ করে।

২.কতক উলামায়ে কেরামের মতে রোগের সংক্রমণ বলতে কিছু নেই।

৩.কিছু উলামায়ে কেরাম বলেন, সকল ক্ষমতা আল্লাহর তাই আল্লাহ যদি চান তাহলে রোগ অন্যত্র সংক্রমণ করবে আর যদি আল্লাহ না চান তাহলে রোগ অন্যত্র সংক্রমণ করবে না।

শেষোক্ত মতটি অগ্রগণ্য। বক্ষমাণ প্রবন্ধে এমতটিই গ্রহন করা হয়েছে।

  • ৫) প্রশ্ন হলো এ সকল রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি থেকে দুরে থাকা যাবে কি না;

এ প্রশ্নের উত্তর হলো, হাঁ, এসকল রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের থেকে দুরে থাকা যাবে বরং দূরে থাকাই উচিৎ। (শরহুয যুরক্বানী,৪;৪২৫)
কেননা,

১.আল্লাহর ইচ্ছা হলে ঐ রোগ অন্যত্র সংক্রমণ করতেও পারে তাই এক্ষেত্রে আপনি দূরত্ব অবলম্বন করতে পারেন।

২.তাছাড়া নিজের ঈমানও সুরক্ষিত থাকবে। কেননা যদি ঐ ব্যাক্তির পাশে যাওয়ার পর আপনি রোগে আক্রান্ত হন তাহলে আপনার মনে একথা আসতে পারে যে, এই রোগীর কাছে না আসলে হয়ত আপনার এই রোগ হতো না অথচ আল্লাহ চাইলে আপনি এই রোগীর কাছে না আসলেও সে উক্ত রোগে আক্রান্ত হতো।

এবং আপনি তখন রোগকে নিজস্ব ক্ষমতায় সংক্রমক ভাববেন অথচ সকল ক্ষমতা তো আল্লাহর।

এজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ;

 ” فر من المجذوم كما تفر من الأسد”

অর্থাৎ সিংহ থেকে যেমন দুরে থাকো কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি থেকে তেমন দুরে থাকো।
(সহীহ বুখারী, ১১২০, হাদীস নং:৫৭০৭)

তদ্রুপ সাকীফ গোত্রের এক কাফেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বায়আত হতে এলো। তারা বাইয়াত গ্রহন করার পর বললো আমাদের সাথে এক ব্যাক্তি এসেছে, সে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত । নবীজী তাকে বললেন: قَدُ بَايَعْنَاكَ فَارْجِعْ    অর্থ:    তুমি ফিরে যাও, তোমার বায়আত হয়ে গেছে।
(সহীহ মুসলিম, পৃষ্ঠা: হাদীস নং: ৫৯৫৪)

 অন্যত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ; 

لا يوردن ممرض على مصح

রোগে আক্রান্ত উটের মালিক যেন তার ‍উটকে সুস্থ উটের কাছে নিয়ে না যায়।
(সহীহ ‍বুখারী, পৃষ্ঠা:১১৩০, হাদীস নং:৫৭৭১)

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন;

إذَا سمِعْتُمْ الطَّاعُونَ بِأَرْضٍ، فَلاَ تَدْخُلُوهَا، وَإذَا وقَعَ بِأَرْضٍ، وَأَنْتُمْ فِيهَا، فَلاَ تَخْرُجُوا مِنْهَا

অর্থাৎ “যখন তোমরা শুনবে যে, কোন স্থানে প্লেগ-রোগ হয়েছে, তাহলে সেখানে প্রবেশ করো না। আর যখন কোন স্থানে সেই রোগের প্রাদুর্ভাব হয় এবং তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান হতে বের হয়ে যেয়ো না।”
(সহীহুল বুখারী, হাদীস নং ৫৭২৮/ সহীহু মুসলিম, হাদীস নং ৫৯০৫)

এ হাদীসটি থেকেই মূলত আমাদের বর্তমান হোম কোয়ারেন্টাইনের ধারনা।

উল্লেখিত হাদীসগুলো থেকে বোঝা যায়,
কেউ যদি এ সকল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দুরে থাকতে চায় তাহলে সে দুরে থাকতে পারে। এটি শরীয়াহ পরিপন্থী কোন কাজ হবে না।
এক্ষেত্রে আবশ্যকীয় শর্ত হলো,
ব্যক্তির ভিতরে এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে থাকতে হবে যে, আল্লাহ চাইলেই কেবল রোগ তার পর্যন্ত সংক্রমণ করবে, অন্যথায় নয়।

আর যদি কেউ দুরে না থাকে তাহলে তাও তার জন্য বৈধ। কেননা আল্লাহ চাইলে রোগীর সংস্পর্ষে না গেলেও সে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তো দুরে থেকে কতটুকুই বা লাভ !

ফলাফল দাড়ালো যে, সব কিছু আল্লাহ ইচ্ছাধীন।

  • ৬) এক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের আমল ;

এসকল রোগে আক্রান্তের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণ কি পদ্ধতি গ্রহন করতেন সে বিষয়ে জানা প্রয়োজন। নিচে তাদের আমলী পদ্ধতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয় হলো;

পূর্বে আমরা বলে এসেছি যে, এসকল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে দুরে থাকা! না থাকা উভয় পদ্ধতিই আবলম্বন করা বৈধ, তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের আমলও দু’ধরনের।

ক: দূরত্ব অবলম্বন করা।

যেমন:

১.সাকীফ গোত্রের এক কাফেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বায়আত হতে এলো। তারা বাইয়াত গ্রহন করার পর বললো আমাদের সাথে এক ব্যাক্তি এসেছে। সে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন: قَدُ بَايَعْنَاكَ فَارْجِعْ  অর্থ: তুমি ফিরে যাও, তোমার বায়আত হয়ে গেছে।
(সহীহ মুসলিম, পৃষ্ঠা: হাদীস নং: ৫৯৫৪)

২. একবার ওমর রা. সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে শামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে সাহাবীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ এসে বললেন; শামে মহামারির প্রদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তখন ওমর রা. সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করলে তাদের মাঝে মতানৈক্য দেখা দিলো। তখন কোরাইশদের মধ্যে বড়রা সকলেই বললেন যে, আপনি শামে যাবেন না বরং মদীনায় ফিরে চলুন। তখন ওমর রা. শামে না গিয়ে মদীনায় ফিরে গেলেন।
(মুয়াত্বা মালেক, হাদীস:২৬৩৩)

৩.উমর রা. মুআইকীব রা. কে বললেন ;   اجلس منى قيد رمح  অর্থ: তুমি আমার থেকে এক বর্ষা পরিমাণ দুরে থাকো। আর মুআইকীব রা. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। 
(শরহু ইবনে বাত্তাল,১৮:১৪)

৪.ইবনে হাবীব রহ. বলেছেন:

 يمنع المجذوم من المسجد والدخول بين الناس واختلاطته بهم 

অর্থ: কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মসজিদে আসতে, মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সাথে মেলা-মেশা করতে বাধা দিতে হবে।
(শরহু ইবনে বাত্তাল,১৮:১৪)

৫. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত  এক মহিলা তাওয়াফ করছিল। উমর রা. বললেন ;

اقعدى فى بيتك ولاتؤذى الناس   

অর্থ: তুমি ঘরে থাকো, মানুষকে কষ্ট দিও না।
(শরহু ইবনে বাত্তাল,১৮:১৪)

৬. আমর ইবনুল আস (রা.)- তার সময়ে মহামারি রোগকে কেন্দ্র করে  মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়ে বলেন, ‘হে লোকেরা, এই রোগের প্রাদুর্ভাব হলে তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে, তাই তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নাও। এক বর্ণনা মতে, তোমরা পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন উপত্যকায় চলে যাও অতঃপর সবাই বেরিয়ে পড়ে বিভিন্ন পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এই বিপদ থেকে তাদের মুক্ত করেন। আমর (রা.)-এর গৃহীত পন্থা খলিফা উমর (রা.) জানতে পারেন। তিনি তা অপছন্দ করেননি। (ফাতহুল বারি, ১০/১৯৯)

৭.ইকরিমা রহ. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকতেন।
(শরহু ইবনে বাত্তাল,১৮:১৪)

খ: দূরত্ব অবলম্বন না করা।

অর্থাৎ কখনো এমনও হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম এসকল রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের থেকে দুরে থাকে নি। যেমন :

১.একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত ধরে দস্তরখানে বসালেন ও বললেন ;
 كل ثقة بالله وتوكلا عليه   অর্থ:আল্লাহর উপর ভরসা করে খাও।

২. একবার স্বাকীফ গোত্র আবু বকর রা. এর নিকট আসলো। সেখানে খাবারের ব্যবস্থা করা হলে এক ব্যক্তি দূরে থাকলো। আবু বকর রা. জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে তোমার ? সে বললো; আমি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। আবু বকর রা. তখন তাকে ডেকে তার সাথে খাবার খেলেন।

৩. সালমান ফারসী ও ইবনে ওমর রা. কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য খাবার তৈরী করতেন ও তাদের সাথে খাবার খেতেন।

৪. আয়েশা রা. বলেন: »

وكان مولى لى أصابه ذلك الداء فكان يأكل فى صحافى ويشرب فى أقداحى وينام على فراشى   

অর্থ: আমার এক গোলামের এই রোগ হয়েছিলো। সে আমার প্লেট ও পাত্রে পানাহার করতো ও আমার বিছানায় ঘুমাতো।
(শরহু ইবনে বাত্তাল,১৮:১৪)

পাঠক উপরে নবী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের বিভিন্ন আমল জানলেন। তাই আপনিও দূরে থাকা-না থাকা যে কোন একটি পথ অনুসরণ করতে পারেন। এতে অসুবিধার কিছু নেই।

  • ৭) হাদীস থেকে শিক্ষা;

পাঠক এতক্ষণে ‍নিশ্চয় উপরে দুরকমের হাদীস জেনেছেন। এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, রোগ সংক্রমণ নেই। অপর এক হাদীসে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দুরে থাকতে বলা হয়েছে।

পাঠক এও জেনেছেন যে, এসংক্রান্ত দু’ধরনের হাদীসেরে মধ্যে মূলত বৈপরিত্য নেই।

আল্লামা ওয়াসীম ফাতহুল্লাহ বলেন : উপরোক্ত হাদীস থেকে শিক্ষণীয় দুটি বিষয় হলো ;

১.এক দৃষ্টিকোণ থেকে রোগ সংক্রমণ করে। আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে রোগ সংক্রমণ করে না।

আল্লাহই কিছু কিছু রোগের মধ্যে সংক্রমণের ক্ষমতা দিয়েছেন সে হিসেবে রোগ অন্যত্র সংক্রমণ করে তবে নিজস্ব ক্ষমতা বলে রোগ অন্যত্র সংক্রমণ করে না।

২.বিভিন্ন আসবাব অর্থাৎ বাহ্যিক উপকরণে আল্লাহ প্রদত্ত কিছু শক্তি থাকে। তবে তা তার নিজস্ব শক্তি নয়।
(তুহফাতুল আতীব্বা মিন কালামি খায়রিল আম্বীয়া,১:১৪)

  • ৮) পূর্বের আলোচনার সারাংশ;

পাঠকের সুবিধার্থে  নিচে পূর্বের আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি;

  • ১.সকল ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা’লা।
    আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না। এ বিশ্বার রাখা সকল মুমিনের জন্য আবশ্যক। এ বিশ্বাস ছাড়া কোন ব্যাক্তি মুসলমান হতে পারে না।
  • ২.কোন কোন বস্তুর মধ্যে আল্লাহ কিছু ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন।
    যেমন, ঔষধের মধ্যে রোগ নিরামকের ক্ষমতা। আগুনের মধ্যে পুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা। ছুরির মধ্যে কেটে ফেলার ক্ষমতা। তদ্রুপ কিছু রোগের মধ্যে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা তবে এসকল ক্ষমতা এদের নিজস্ব নয়, বরং তা সকল ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর পক্ষ থেকেই দেয়া।
  • ৩.এই ক্ষমতাও আবার আল্লাহর ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
    আল্লাহর ইচ্ছা না থাকলে দেখা যাবে এই ক্ষমতা কাজ করছে না।
  • ৪.এসকল বিষয় বিশ্বাস রাখার সাথে সাথে নিজের সতর্কতা অবলম্বন করা যাবে
    আর সেজন্য এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি থেকে দুরে থাকতে চাইলে দুরে থাকা যাবে।

প্রকাশ থাকে যে, প্রথম তিনটি বিষয় বিশ্বাস ও আক্বীদা সংক্রান্ত (Thurical)  আর চতুর্থ বিষয়টি (Practical)।

৫.সতর্কতা অবলম্বন করা স্বত্বেও  যে কোন রোগ হতে পারে।
কেননা এটা আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ চাইলে সংস্পর্শ ছাড়াও এ রোগ হতে পারে।

বি.দ্র.
হাদীসে কেবল রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তি থেকে দুরে থাকতে বলা হয়েছে সুতরাং কেউ যদি রোগে আক্রান্ত না হয়ে থাকে বা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থাকে তাহলে তার থেকে দূরত্ব অবলম্বনের মাত্রা কিছুটা কম করা যেতে পারে।

সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য হবে। যে ব্যক্তি নিশ্চিত করোনায় আক্রান্ত কেবল তার থেকে দুরে থাকার আদেশই হাদীসে করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে যে ব্যাক্তি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত নয়, তার থেকে দুরত্ব অবলম্বনের মাত্রা আর নিশ্চিত করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দুরে থাকার মাত্রা এক পর্যায়ের হওয়া সমীচীন নয়। উপরোন্ত কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা না করে পালিয়ে যাওয়া জঘন্য অমানবিক আচরণ বৈ কি ? অথচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের গবেষণা অনুযায়ী মৃত্যুর পর ব্যক্তির মাঝে ভাইরাস থাকেই না।

  • ৬. পাঠক নিশ্চয় উপরে বিভিন্ন হাদীস ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈদের বিভিন্ন আমল জেনেছেন।
    বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিজ্ঞ ফুকাহা ও উলামায়ে কেরামের পক্ষেই কেবল এই বিভিন্নমুখী হাদীস ও আমলের সঠিক মর্মার্থ ও  উদ্দেশ্য বোঝা সম্ভব। তাই এসকল ক্ষেত্রে জনসাধারণের জন্য আবশ্যক হলো উলামায়ে কেরামের নির্দেশনা অনুসরণ করা।

আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে সঠিকভাবে বোঝার তাওফীক দান করেন। আমীন।

গ্রন্থপঞ্জি

  • ০১.আল-কুরআনুল কারীম,
  • ০২.তাফসীরে কুরতুবী,
  • ০৩.সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, 
  • ০৪.ফাতহুল বারী,
  • ০৫.তুহফাতুল আতীব্বা মিন কালামি খায়রিল আম্বীয়া, 
  • ০৬.শরহু ইবনে বাত্তাল,
  • ০৭.মুয়াত্বা মালেক,
  • ০৮.শরহুয যুরক্বানী, 
  • ০৯.আল-আরফুশ শাযী,  
  • ১০.আল-ফাজরুস সাতে,
  • ১১.আল-মিন্নাতুল কুবরা,  
  • ১২.তুহফাতুল আহওয়াযী,
  • ১৩.উমদাতুল ক্বারী,
  • ১৪.আউনুল ওয়াদুদ,
  • ১৫.ফয়যুল বারী, 
  • ১৬.মিরক্বাতুল মাফাতীহ, 
  • ১৭.বযলুল মাজহুদ।

এখানে মন্তব্য করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

লেখক পরিচিতি

নামঃ মো: রফিকুল ইসলাম।
হিফয বিভাগঃ
(২০০৮ শিক্ষাবর্ষ) নওয়াপাড়া, যশোর, নূরবাগ জামে মসজিদ হেফযখানা।
মাদানী নেসাব
১-৩ বর্ষ ও কাফিয়া জামাতঃ (২০০৯-২০১২ শিক্ষাবর্ষ) জামিয়া ইসলামিয়া ভবানীপুর, গোপালগন্জ।
শরহে বেকায়া- তাকমীলঃ
(২০১৩-২০১৬ শিক্ষাবর্ষ) বাইতুল উলুম, ঢালকানগর।
উলুমূল হাদীসঃ
(২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষ) বাইতুল উলুম ঢালকানগর ।
ইফতা বিভাগঃ
(২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষ) জামিয়া শারইয়্যাহ , মালিবাগ।
শিক্ষকতাঃ প্রধান মূফতী, জামেয়া আনওয়ারুল উলুম আল-ইসলামিয়া, হাজারীবাগ, বটতলা।
মোবাইলঃ +৮৮০১৭৪১-২৬৪৮৯৭
ই-মেইলঃ rafiqulislamjnp@gmail.com

আমাদের অনুসরণ করুন

সর্বশেষ ইউটিউব ভিডিও

সাম্প্রতিক পোস্ট

সাম্প্রতিক পৃষ্ঠা