
মাওলানা সালমান হুসাইন (গোপালগঞ্জ)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-যে সকল আমল নিয়মিত করতেন সাধারনত ছাড়তেন না এর মধ্যে অন্যতম একটি আমল হলো রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করা।
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বর্ণনা করেনঃ-
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত রমাযানের শেষ দশকেই ই‘তিকাফ করতেন। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর সমধর্মিনীগণও ই‘তিকাফ করতেন।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৭৪ সহি বুখারী হাদিস ২০৪১)
অপর এক হাদীসে এসেছ-
– أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ . قَالَ نَافِعٌ وَقَدْ أَرَانِي عَبْدُ اللَّهِ – رضى الله عنه – الْمَكَانَ الَّذِي كَانَ يَعْتَكِفُ فِيهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الْمَسْجِدِ
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমাযান মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করতেন। হাদিসের বর্ণনাকারী নাফি’ (রহঃ) বলেন, মাসজিদের যে স্থানে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ই‘তিকাফ করতেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) তা আমাকে দেখিয়েছেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৭১)
এছাড়াও আরও বহু হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে এতেকাফ করার বিষয়টি উল্লেখ হয়েছে।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;
عن ابن عباس’ عن النبی صلی اللہ علیہ وسلم انہ قال فی المعتکف; انہ معتکف الذنوب.ویجری لہ من الاجر کاجر عامل الحسنات کلہا
অর্থ:- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযিআল্লাহু তা’আলা আ’নহু) হতে বর্ণীত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) ইতেকাফকারী সম্পর্কে বলেছেছেন, সে গোনাহ পরিত্যাগকারী। সমবসয় কোন পূণ্যের কাজে অংশগ্রহনকারীর মতো সে সওয়াব পাচ্ছে। [শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং:৩৬৭৮]
আরেক হাদীসে এসেছে–
من اعتکف عشرا فی رمضان کان کحجتین و عمرتین
যে ব্যক্তি রমযানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করবে,সে দুটি হজ ও দুটি উমরার সওয়াব পাবে।
[শুয়াবুল ঈমান হাদীস নং:৩৬৮১]
[বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮০, রুদ্দুল মুহতার ২/৪৬৯]
ইতিকাফের উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বপ্রকার কাজকর্ম ও ধ্যান ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে শুধু আল্লাহ্ তা’আলার ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকা তাই ইতেকাফ অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, অনর্থক কাজকর্ম ও ফোনালাপ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত।
যথাসম্ভব নফল নামাজ, তেলাওয়াত, যিকির আজকার, তাসবীহ তাহলীল ইত্যাদি ইবাদতে মশগুল থাকা।
ইতিকাফ তিন প্রকার
সুন্নত ইতিকাফ;
রমযানের শেষ দশকে ২১ তারিখ রাত (২০তারিখের সূর্যাস্তের আগে) থেকে ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতেকাফ করা। যেহেতু রাসুল (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতিবছর এ দিন গুলোতে ইতেকাফ করতেন তাই এটাকে সুন্নত ইতেকাফ বলা হয়।
নফল ইতেকাফ;
বছরের যে কোন সময়ে মসজিদে ইতেকাফের নিয়তে অবস্থান করা হচ্ছে নফল বা মুস্তাহাব ইতেকাফ।
সুতরাং রমযানের শেষ দশকে পূর্ণ দশ দিনের কম সময়ের জন্য ইতেকাফ করাও নফল হিসেবে গন্য।
ওয়াজিব ইতিকাফ;
মান্নত করার কারণে যে ইতিকাফ করতে হয়। তদ্রুপ সুন্নত ইতিকাফ ফাসেদ হওয়ার কারণে যে ইতিকাফ কাজা করতে হয় এটাও ওয়াজিব।
ইতিকাফের প্রধান রুকন হল, ইতেকাফকারী সর্বদায় মসজিদের সীমানার ভেতর অবস্থান করবে। অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া একটু সময়ের জন্যেও বাইরে যেতে পারবে না, বাইরে গেলে ইতিকাফ বিনষ্ট হয়ে যাবে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘মসজিদে’ বলতে কেবল এতটুকু অংশকে বুঝায় যতটুকুকে মসজিদ নির্মাতাগণ ‘মসজিদ’ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
সুতরাং অজুখানা, গোসলখানা, জানাজার নামাজের জায়য়গা ইমাম সাহেবের কক্ষ ইত্যাদি জায়গা মসজিদের অংশ নয়।
শরীয়ত সমর্থিত কারণ ছাড়া এসব স্থানে গেলেও ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে।
সাধারণভাবে আমরা এতটুকু বুঝি যে, যেখানে নামাজ হয় বা যতটুকু জায়গায় নামাজ পড়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, এতটুকু জায়গা মসজিদ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর বাইরে মসজিদের জায়গা মসসজিদ নয়।
ইতিকাফকারী ইতিকাফে বসার আগে মসজিদের সীমানা জেনে নেওয়া আবশ্যক। নইলে অজ্ঞাতসারে তার ইতিকাফ ভঙ্গে যেতে পারে।
শরীয়তসম্মত কিছু কাররণে ইতিকাফকাররী মসজিদের বাইরে যেতে পারবে। এসব কারণ ছাড়া বাইরে গেলে তার ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।
(আননুতাফু ফাল ফতোয়া ১৬৭, ফতোয়ায় হিনি্দয়া ১/২১১)
একজন পুরুষ যেমনিভাবে ইতিকাফ করে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করতে পারে তেমনিভাবে একজন মহিলা ও চাইলে সে ইতেকাফের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর নিকট নৈকট্য অর্জনকারী দের সাথে শামিল করতে পারে। হাদিস শরীফে এসেছেঃ
أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ
عَزَّ وَجَلَّ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ
(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত রমাযানের শেষ দশকেই ই‘তিকাফ করতেন। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর সমধর্মিনীগণও ই‘তিকাফ করতেন।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৭৪ সহি বুখারী হাদিস ২০৪১)
মহিলারা ঘরের নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের জন্য নির্ধারিত স্থানে ইতেকাফ করবেন। যদি পূর্ব থেকে ঘরে নামাজের জন্য এমন কোনো স্থান নির্ধারিত না থাকে তাহলে ইতেকাফের জন্য একটি স্থান নির্ধারিত করে সেখানেই এতেকাফ করবেন।
[হেদায়া ১/২৩০]
রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফ পুরুষের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আ’লাল কিফায়া হলেও নারীদের জন্য তা মুস্তাহাব।
বিবাহিতা মহিলারা রমযানের শেষ দশকের ইতেকাফ বা অন্য সময়ের নফল ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। বিবাহিতা মহিলা স্বামীর অনুমতি ছাড়া ইতেকাফ করা অনুচিত। স্বামীর অনুমতি নিয়ে মহিলারা ইতেকাফ করতে পারবেন আর স্বামীদের উচিত যুক্তিসঙ্গত, গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া স্ত্রীদের এতেকাফ বারণ না করা, তাদের ইতেকাফের সওয়াব থেকে বঞ্চিত না করা।
[বাদায়ে ২/২৭৪]
স্বামী স্ত্রীকে ইতেকাফের জন্য অনুমতি দেয়ার পর তাকে আর ইতেকাফে বাধা দিতে পারবে না। যদি বাধা দেয় তাহলে সে বাধা মানা স্ত্রীর কর্তব্য নয়।
[শামী ৩/৪২৯, আলমগীরি ১/২১১]
ইতেকাফ অবস্থায় দিন-রাতে কোনো সময়ই স্বামী-স্ত্রী মেলামেশা করা যাবে না। করলে এতেকাফ ভেঙ্গে যাবে।
[সূরা বাকারা আয়াত ১৮৭, বাদায়ে ২/২৮৫, শামী ৩/৪৪২, হেদায়া ১/২৩১]
স্বামী স্ত্রীকে ইতেকাফের জন্য অনুমতি দেয়ার পর তার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না।
[শামী, ৩/৪২৯]
মহিলাদের ইতেকাফের জন্য হায়েজ, নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া শর্ত। হায়েজ নেফাসের অবস্থায় ইতেকাফ সহি হয় না।
[বাদায়ে ২/২৭৪, আলমগীরি ১/২১১, শামী ৩/৪৩০]
মহিলাদের সুন্নাত ইতেকাফে বসার আগেই হায়েজ-নেফাসের দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশ করে বসাই উচিত। যাতে এতেকাফ শুরু করার পর হায়েজ (মাসিক) শুরু হয়ে না যায়। তবে কারও যদি রমযানের শেষ দশকে হায়েজ হওয়ার নিয়ম থাকে তাহলে তিনি হায়েজ শুরু হওয়া পর্যন্ত নফল ইতেকাফ করতে পারেন। হায়েজ শুরু হওয়ার আগেই ঔষুধ-বড়ি খেয়ে হায়েজ (মাসিক) বন্ধ রেখে রোযা রাখলে ইতেকাফ করলে রোযা ও ইতেকাফ সহীহ হবে।তবে এমন কাজ করা মোটেও ঠিক নয়।
কোনো মহিলা ইতেকাফ শুরু করার পর যদি তার হায়েজ (মাসিক) শুরু হয়ে যায় তাহলে তার ইতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং পরে শুধু একদিনের এতেকাফ রোযাসহ কাজা করতে হবে।
[আহসানুল কাতাওয়া ৪/৫০২]
মহিলারা ঘরের যে স্থান ইতেকাফের জন্য নির্ধারণ করবে ইতেকাফ অবস্থায়, তা পুরুষের ক্ষেত্রে মসজিদের মতো গণ্য হবে। অর্থাৎ মানবিক প্রয়োজন ছাড়া সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে না। মানবিক প্রয়োজন ছাড়া সে স্থানের বাইরে গেলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
[আলমগীরি ১/২১১, বাদায়ে ২/২৮২]
মানবিক প্রয়োজন বলতে বোঝায় প্রস্রাব-পায়খানা। মহিলারা ইতেকাফ অবস্থায় ঘরের নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থান থেকে শুধু কেবল প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বের হতে পারবেন। অজুর জন্যও বাইরে যেতে পারবেন। খাবার পৌঁছে দেয়ার লোক না থাকলে খাবার আনার জন্য বাইরে যেতে পারবেন।
[বাদায়ে ২/২৮২, হেদায়া /২৩০, শামী ৩/৪৩৫]
পানাহার ইতেকাফের জায়গায় অর্থাৎ নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে করতে হবে। বাইরে করা যাবে না।
[হেদায়া ১/২৩০]
ইতেকাফের জায়গায় থেকে অন্যদের সাংসারিক কাজের ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া যাবে। বাইরে যাওয়া যাবে না। রান্না-বান্নার লোক না থাকলে ইতেকাফের রুম থেকে রান্না-বান্নার কাজ সম্ভব হলে করা যাবে।
[মাহমুদিয়া ১৫/৩৩৪]
কোনো মহিলার স্বামী যদি মাজুর হয় তার সেবা-যত্নের প্রয়োজন হয়, তাহলে সে মহিলার উচিত হচ্ছে ইতেকাফে না বসে বরং স্বামীর সেবা-যত্ন, দেখাশোনা করা। কারণ সওয়াবের নিয়তে স্বামীর খিদমত সেবা-যত্ন করলে ইতেকাফের চেয়ে অধিক সওয়াব পাওয়া যাবে। যে মহিলার ছোট ছোট সন্তান আছে এবং তাদের লালন-পালন ও দেখাশোনার কেউ নেই এমন মহিলারও উচিত ইতেকাফে না বসে সন্তানের লালন-পালন ও দেখাশোনা করা। যে মহিলার সাবালগ মেয়ে আছে। তাদের দেখাশোনার জন্য কেউ নেই। সে মহিলারও উচিত ইতেকাফে না বসে বরং সাবালগ মেয়ের দেখাশোনা করা।
(আহকামে রমজান ও যাকাত, ৬৪)
বর্তমানে মহিলারা খুব কমই ইতেকাফ করেন। অথচ ইতেকাফ অত্যন্ত সওয়াবের কাজ আর মহিলাদের জন্য ইতেকাফ তো সহজও বটে।
আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের মা-বোনদেরকে আমল করার তাওফীক দান করেন। আমীন.
যদি কোন ব্যক্তি পান্জেগানা মসজিদে ইতেকাফ করে তাহলে সে জুমার নামাজের জন্য অন্য মসজিদে যেতে পারবে, এতে কোনসমস্যি নেই।তবে রাস্তায় কোন কথাবার্তা বলবে না।
অতঃপর নামায পড়ে নিজ মসজিদে (যেখানে তিনি ইতেকাফে বসেছেন) চলে আসবে।
নামঃ মুহাম্মদ সালমান হুসাইন।
ইফতাঃ ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ।
উলুমুল হাদিসঃ ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ, মাদ্রাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর।
তাকমীলঃ ২০১৫ শিক্ষাবর্ষ, মাদ্রাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর।
হিফজঃ ২০০৭ শিক্ষাবর্ষ, জামিয়া আরাবিয়া হাজী ইউনুস কওমী মাদ্রাসা।
সিনিয়র শিক্ষকঃ হাজিপাড়া কাশীপুর নারায়ণগঞ্জ
কপিরাইট © ২০২৪ ইসলামী শরীয়াহ্ অর্গানাইজেশন. সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত. ব্যবহারবিধি ও স্বত্বাধিকার আইন.